প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার
তামাকের উপর কর কমানোর সুপারিশ লাভবান করে তামাক কোম্পানীকে
২০১৮ সালে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বাংলাদেশে ১,২৬,০০০ জন মারা যায়। বাংলাদেশে প্রায় ৩৫% প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। সম্প্রতি গবেষনায় প্রমাণিত তামাক ব্যবহারের কারণে ধূমপায়ীদের কোভিড ১৯ এর ঝুঁকি ১৪ গুন বেড়ে যায়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, অথচ একইসময়ে (২০১৭-১৮) তামাকখাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ মাত্র ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। একটি বড় তামাক কোম্পানীর ওয়েব সাইটে উল্লেখ রয়েছে, তারা সিগারেট শিল্পর মাধ্যমে দেশের রাজস্ব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে ও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রাজস্ব প্রদান করছে। (BAT Bangladesh, 2019) । রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজস্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় সন্দেহ নেই। তবে রাজস্বটা কোন খাত থেকে আসছে এবং এ পরিমান রাজস্ব দিয়ে তারা রাস্ট্রের কোন কোন সেক্টর কে ক্ষতিগ্রস্থ করছে এটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তামাক কোম্পানিগুলো নীতি নির্ধারকদের কাছে বারবার তুলে ধরে তারা যেহেতু অনেক টাকা রাজস্ব প্রদান করছে সুতরাং তামাক পণ্যের মূল্য কম থাকা অত্যন্ত জরুরী। না হলে সরকার রাজস্ব হারাবে। বিগত ১০ বছরের দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তামাক কোম্পানিগুলো প্রতিবছরই (পরবর্তী অর্থ বছরের বাজেট প্রণয়নের সময়কালে অর্থাৎ মার্চ-জুন মাসে) তামাকজাত দ্রব্যের উপর শুল্ক প্রত্যাহারের দাবীতে অবস্থান কর্মসূচী, মহাসমাবেশ, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ এবং মাথায় করে বয়ে এনে স্মারকলিপিসহ নীতি নির্ধারকদের কাছে হস্তান্তরসহ নানা কর্মসূচী পালন করছে। এসকল কর্মসূচীর উদ্দেশ্য থাকে বাজেট চলাকালীন সময়ে অস্থির একটা অবস্থা তৈরী। যার মাধ্যমে নীতি নির্ধারকদের তামাকের উপর কর বৃদ্ধি দেশের শ্রমিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অন্তরায় এমন ধারনা প্রদানের চেষ্টা করা হয়।
একটা বিষয় মনে রাখা জরুরী স্বাস্থ্য এবং জীবনের চেয়ে অর্থ কোনভাবেই অধিক মূল্যবান নয়। বহু অর্থ ব্যয় করেও একটি জীবন ফিরিয়ে আনা যায় না। যার প্রমাণ আমরা এই কোভিড-১৯ মহামারীর সময়েও পেয়েছি। কোন কল্যাণ রাস্ট্রের জন্য জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলা কাংখিত নয় বলেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নেশা বা মাদক ব্যবসা প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। শুধু তাই নয় মাদকের প্রবেশ পথ তামাক নিয়ন্ত্রণেও গ্রহণ করছেন ধারাবাহিক নানা পদক্ষেপ। কিন্তু বিদ্যমান দূর্বল ও বহু স্তর বিশিষ্ট তামাক কর কাঠামো এবং তামাক কোম্পানীগুলোর কৌশলের কারণে তামাকের উপর এখনো সঠিভাবে করারোপ সম্ভব হয়নি। যার ফলে দেশে তামাকের ক্ষেত্রে এমন কর কাঠামো বিদ্যমান রয়েছে যেখানে সরকারের চেয়ে কোম্পানীর লাভ অনেক বেশী। অর্থনৈতিক উন্নতি ও জনগণের আয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে তামাকজাত দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি না পাওয়ায় সবধরনের তামাকজাত পণ্য মানুষের (বিশেষ করে তরুণদের) ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রয়ে গেছে। যে কোন পণ্যের উপর কর বৃদ্ধি করা হলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবার এবং সে অনুসারে বাড়তি মূল্যের পুরোটাই রাজস্ব হিসাবে সরকারের কোষাগারে জমা হবার কথা। কিন্তু কর বৃদ্ধি না করে শুধু মূল্য বৃদ্ধি করা হলে বাড়তি মূল্যটুকু কোম্পানী ও সরকারের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। বাংলাদেশে তামাকের জটিল কর কাঠামো এবং বছরের পর বছর কর বৃদ্ধি না করে শুধু দাম বাড়ানোতে ফুলে ফেঁপে উঠছে কোম্পানীগুলোর মুনাফা। এরপরও তামাক ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখতে তামাক কোম্পানীগুলো নানাকৌশলে সরকারের দৃস্টি আর্কষনের চেষ্টা অব্যহত রেখেছে। বিগত সময়ে তামাকের কর বৃদ্ধি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ করতে তামাক কোম্পানি কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এর অধিকাংশই অসত্য ও বিভ্রান্তিকর।
এবছরও আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটে বিড়ির উপর বিদ্যমানশুল্ক কমানোর সুপারিশ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ডিও লেটার দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শতাধিক সংসদ সদস্য। তামাক কোম্পানীর পক্ষে সংসদ সদস্যদের ডিও লেটার প্রদানের ঘটনাও নতুন কিছু নয়। বিগত দিনেও এধরনের উদাহরণ রয়েছে। ২০১১ সালে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের একটি কর্মসূচীতে তৎকালীন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুজিবর রহমান ফকির বলেছিলেন, “সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের অনেকেই সিগারেট কোম্পানিগুলোর জন্য তদবির করছেন। একটি চক্র সুকৌশলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে” (ইযড়ৎবৎ কধমড়ল, ২৯ মে ২০১১)। জনগনের ভোটে নির্বাচিত যে সকল প্রতিনিধিরা তামাকের মতো ক্ষতিকর দ্রব্যর প্রসারে পত্র প্রদান করছে উনাদের কাছে ভেবে দেখার অনুরোধ করছি, নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে রাখার বা প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপর কর কমানোর জন্য অথবা করোনার কারণে বাস ভাড়া, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এসকল জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কি উনারা এমনভাবে চিঠি দিয়েছেন কিনা? তাহলে তামাকের মতো স্বাস্থ্য, পরিবেশ অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর পণ্যের উপর বিদ্যমানশুল্ক কমানোর সুপারিশ করে কেন ডিও দিচ্ছেন? শুধু তাই নয় বিগতদিনে শহীদ মিনার, মুক্তাঙ্গণে কুটির শিল্প বিড়িকে করমুক্ত রাখার দাবীতে বিড়ি শ্রমিকদের জাতীয় মহাসমাবেশ করতে দেখা গিয়েছিল।
যাদের বাচাঁনোর দাবী জানিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো নীতি নির্ধারকদের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করে প্রকৃতপক্ষে তারা কি যথাযথ মজুরী, কাজের পরিবেশ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবনের নিরাপত্তা পাচ্ছে? বিভিন্ন সময়ে বকেয়া বেতনসহ নানা দাবীতে বিড়ি শ্রমিকদের রাজপথে আন্দোলন করতে হয়েছে। ঢাকা, টঙ্গী, যশোর, রংপুর ও রংপুরের হারাগাছা, বাগেরহাটের মোল্লার হাট, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা ও দৌলতপুর, লালমনিরহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় সোনালী টোবাকো, আলফা টোবাকো, ঢাকা টোবাকো, আকিজ বিড়ি ইত্যাদি কোম্পানিগুলোতে চরম শ্রমিক অসন্তোস, অনেক সময় শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকপক্ষের সংঘর্ষের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। যশোরে আলফা টোব্যাকো ফ্যাক্টরিতে মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে শ্রমিকদের আন্দোলন করতে দেখা গেছে। শ্রমিকরা দাবী করে মালিকরা কোটি কোটি টাকা মুনাফা করলেও শ্রমিকদের কল্যাণে কিছুই করেনি (আমার দেশ, ১৭ এপ্রিল ২০০৮)। বিড়ি কোম্পানিগুলোতে শ্রমিকদের একটা বড় অংশকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ করা হয়। নারী শ্রমিকদের নেই মাতৃত্বকালীন কোন ছুটির ব্যবস্থা। সন্তানসম্ভবা নারী শ্রমিকদের কোন কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়াই ছাটাই করা হয়। মাথাপিছু উৎসব বোনাস প্রদান করা হয় মাত্র ১০০ টাকা (সমকাল , ১৫ জুন ২০০৮)। নীলিফামারীতে তামাক কারখানাগুলোতে স্বাস্থ্য বিধি না মানার দৃষ্টান্ত রয়েছে। বহু রোগে আক্রান্ত শ্রমিকরা। মালিকদের উদাসীনতার কারণে কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের একটি বড় অংশ যক্ষা, হাঁপানী, শ্বাসকষ্ট, আলসার, বার্জাজসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে ঝুকে পড়তে দেখা গেছে। নামমাত্র মূল্যে জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে তামাক কারখানাগুলোতে কাজ করছে অনেকেই (দৈনিক সংগ্রাম, ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯)। হারাগাছায় হাজার হাজার সাধারণ বিড়ি শ্রমিকদের বিক্ষোভ মিছিল এবং মালিকদের বাড়ী ও কারখানা ঘেরাও করতে দেখা গেছে। ((Songbad, 2 August 2009) বিভিন্ন সময়ে সংঘর্ষে বিড়ি শ্রমিক নিহত, বহু আহত ও অনিদিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট হয়েছে (যুগান্তর, ১৬ জুলাই ২০১২)। শ্রমিকদের অত্যন্ত কম মজুরী, দীর্ঘদিন মজুরী বৃদ্ধি না করা, সপ্তাহ (সাপ্তাহিক মজুরী) ঠিকভাবে না দেওয়া ইত্যাদি বঞ্চনার তথ্যও পাওয়া গেছে। ২০০৭ সালের এক তথ্যানুসারে, সরকার, মালিক এবং শ্রমিকপক্ষ একত্রে বিড়ি শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরী প্রতি হাজার বিড়ির জন্য ২১ টাকা নির্ধারণ করে। কিন্তু সরকারের এই নির্দেশনাকে ফ্যাক্টরি মালিকরা বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে শ্রমিকদের তাদের মনগড়া সামান্যতম মজুরী দিয়ে ফ্যাক্টরী সচল রাখে (Ajkaler Khobor, 11 March 2010). শুধু বিড়ি কারখানা নয় বিট্রিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) এর কারখানাতেও শ্রমিক অসন্তোষ এর সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। শ্রমিকরা ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের কার্যালয়ে আটকে রাখে (বণিক বার্তা, ১২ মে ২০১৪)। গণমাধ্যমে প্রেস কনফারেন্স এর মাধ্যমে বিএটিবি’র অস্থায়ী শ্রমিকরা অভিযোগ করেন যে, তারা নানাভাবে বঞ্চনার শিকার। একজন স্থায়ী শ্রমিকের সমান কাজ করলেও তাদের নুন্যতম বেতন-ভাতা ও সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয় না। পদ খালি থাকার পরও ১২/১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন অস্থায়ী শ্রমিককে খালি পদে নিয়োগ দেওয়া হয় না। (Daily ittefaq, 9 March 2009)
তামাক কোম্পানিগুলো শুধু তামাকের উপর কর বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে নানাভাবে বাধাগ্রস্থ করছে না, বিগত দিনে তারা বিপুল অংকের কর ও ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। কর ফাকিঁর বিষয় সমঝোতার জন্য উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যম্যে জোরালো তদবিরও করেছে। ২০১৮ সালে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) নিম্নমানের সিগারেটের কম বিক্রয় মূল্য দেখিয়ে আট মাসে ১ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকার ভ্যাট ও সম্পূরক কর ফাঁকি দেয় (NTVbd.com, 09 May 2018)। মূল্য কমিয়ে ফেলায় ২০০৯-১০ থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে বিএটিবি’র কাছ থেকে অতিরিক্ত ১৯২৪ কোটি টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কম পায় এনবিআর। (Tax News) পরিহার করা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ থেকে বাঁচতে একের পর নতুন ফন্দি আঁটে বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো । (sharebiz.net, 2017)। বিট্রিশ দৈনিক দ্যা গার্ডিয়ান এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভ্যাট মওকুফ করতে বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার অ্যালিসন ব্লেক ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের রাজস্ব কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেন। এমন তৎপরতা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আইনের পরিপন্থি। (Daily Star, 17 Sept 2017)
শুধু তাই নয়, তামাক কোম্পানি যে অর্থ আয় করছে তার একটি বড় অংশ বিভিন্ন কৌশলে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার হয়। ২০১৬ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, যুক্তরাজ্যে অবস্থিত বিএটি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের কাছ থেকে কারিগরি ও পরামর্শ সেবা গ্রহণের নামে বিএটিবি নয় বছরে ৬১৫ কোটি টাকার বেশি সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধ করেছে। (Bonikbarta, 13 Nov, 2016)
তামাকের উপর কর বৃদ্ধির বিষয়টি আলোচনায় এলেই দেশে সিগারেট চোরাচালান বেড়ে যাবে বলে তামাক কোম্পানী এবং তাদের স্বপক্ষের ব্যক্তিদের আওয়াজ তুলতে দেখা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে কি শুধু সিগারেট চোরাচালান হয়? বিগত দিনে চোরাচালানকৃত পণ্যের তালিকায় রয়েছে সোনা, মুঠোফোন, ভারতীয় গরু, মদ, গাজা, মাদক দ্রব্য, মুদ্রা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, কাপড়, ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য, কাঠ, অস্ত্র, কষ্টি পাথরের মূর্তি….ইত্যাদি (Daily Inqilab., 2016)। বাংলাদেশে এতগুলো পন্য চোরাচালান হলেও শুধুমাত্র চোরাচালানকৃত সিগারেট প্রতিরোধ সপ্তাহ প্রসঙ্গে বিগতদিনে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহা-পরিচালকের পক্ষ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর চেয়ারম্যান বরাবর “চোরাচালানকৃত সিগারেট প্রতিরোধ সপ্তাহ “টার্গেটিং স্মাগলড সিগারেট” আয়োজনে দৃষ্টি আর্কষন করা হয়। চোরাচালানের অযুহাতে সারাদেশে তামাকের প্রচারনার উদাহরণ বিগত দিনে আরো রযেছে। ২০১৮ সালে সরকারের কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট এর নামেও বিভিন্ন দোকানে দোকানে এধরনের পোষ্টার লাগাতে দেখা গেছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞদের মতে এটি মূলত তামাক কোম্পানির এক ধরনের বিজ্ঞাপন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে‘অবৈধ সিগারেট পরিবহন, পরিবেশন, বিক্রয় এবং ক্রয় করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ’ বলে জনসাধারণকে সতর্ক করে প্রচারিত এ বিজ্ঞাপনে একটি সিগারেটের প্যাকেটের ছবি প্রদর্শিত হয়; যাতে কয়েকটি সিগারেটের অংশ বিশেষ দেখা যায়। ……পুরো বিজ্ঞাপনটিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ‘সিগারেটের প্রচারণা’ বলেই অনেকে অভিহিত করেন (সিলেটের ডাক, ২০১৮)। ২০১৯ সালেও এধরনের পোষ্টার বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে।
প্রকৃতপক্ষে চোরাচালানের সাথে তামাকের কর বৃদ্ধির কোন সম্পর্ক নেই। বরং চোরাচালানের সাথে রাষ্ট্রের সীমান্ত সুরক্ষিত করার বিষয়টি অধিক সম্পৃক্ত। বিগত কয়েক বছরের পত্রিকা বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে, কর বৃদ্ধির সময়ে বিভিন্ন স্থানে চোরাচালানকৃত সিগারেট উদ্ধার ও বিভিন্ন স্থানে অবৈধ সিগারেট আটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এটি মূলত তামাক কোম্পানীর পক্ষ থেকে তামাকের উপর কর বৃদ্ধির প্রচেষ্টাকে ব্যহত করার একটি কৌশল। সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পদক্ষেপকে ব্যহত করার লক্ষ্যে এ কৌশল কাজে লাগিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো নীতি নির্ধারকদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করে। সুতরাং কর বৃদ্ধির ফলে তামাক চোরাচালান বৃদ্ধি পাবে এমন ভ্রান্ত প্রচারনায় গুরুত্ব না দিয়ে তামাকের উপর ককর বৃদ্ধি, সুনির্দিষ্ট করারোপের পাশাপাশি চোরাচালান রোধে কার্যকর উপায় খুঁজে বের করা জরুরী।
তামাক দেশের উন্নয়নের অন্তরায়। এটি দেশ ও জনগণের ক্ষতি করছে বিধায় ২০১৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তামাকের ব্যবহার কমানোর ক্ষেত্রে এর উপর কর বৃদ্ধিকে একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে উল্লেখ করে তামাকের বিদ্যমান জটিল কর কাঠামো সংস্কার করে সহজ ও শক্তিশালী তামাক শুল্কনীতি প্রণয়নের উপর জোর দিয়েছেন (The Union, 19 Feb 2016)। এছাড়াও আর্ন্তজাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি এফসিটিসি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এটি বাস্তবায়ন নৈতিক দায়িত্ব। টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও এফসিটিসির প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এফসিটিসি এর আটিক্যাল ৫.৩ তে তামাক কোম্পানীর কুটচাল প্রতিহত করে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক নীতি সুরক্ষা এবং আর্টিক্যালে ৬ এ তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর আরোপকে তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং তামাক কোম্পানীর কৌশলে বিভ্রান্ত হয়ে জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলা কোন কল্যাণ রাস্ট্রের জন্য কাম্য নয়। আসন্ন বাজেটে বিদ্যমান দূর্বল ও বহু স্তর বিশিষ্ট তামাক কর কাঠামো সহজীকরণ এবং ৪ স্তর থেকে কমিয়ে ২ স্তরে নিয়ে আশার পাশাপাশি একটি সহজ, শক্তিশালী ও জনবান্ধব তামাক শুল্কনীতি প্রণয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবী। যা জনস্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি দেশের স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নে অবদান রাখবে।
সৈয়দা অনন্যা রহমান, কর্মসূচী ব্যবস্থাপক, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট
anonna@wbbtrust.org