প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার
পটভূমি: তামাকের কারণে জনস্বাস্থ্য ও সামগ্রীক উন্নয়ন হুমকির মুখে পড়ছে। ২০১৮ সালে তামাক সেবনের কারণে প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু হয়েছে। তামাক ব্যবহারে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসায় বাংলাদেশে প্রতিবছর ব্যয় হয় ৩০৫৭০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৯% তরুন, যারা তামাক কোম্পানির মূল টার্গেট। তামাক কোম্পানির নিজ ব্যবসা প্রসারে তামাক পণ্য বিপণনে কূট-কৌশল প্রয়োগের মাধ্যেমে সামগ্রীক উন্নয়নে বাঁধার সৃষ্টির বিষয়টি সম্পর্কে ভাববার এখনই সময়। বর্তমান সময়ে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, কর বৃদ্ধি ও সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর সঠিক বাস্তবায়নে প্রস্তাবিত স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন বিষয়।
টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত ৩টি ধাপে তামাক পণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বাস্তবায়নের উপর কমপ্লায়েন্স মনিটরিং পরিচালনা করে এবং তামাক পণ্যের আদর্শ মোড়কের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রথমবারের মত স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং এর ধারণা তৈরি হয়। ২০১৭-২০১৯ সালে টিসিআরসি দু’বছরব্যাপী বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ২৬৫টি বাজার হতে সিগারেট, বিড়ি, জর্দ্দা, গুলের মোট ১০,০৭৪ টি তামাকপণ্যের মোড়ক মনিটরিংয়ের মাধ্যেমে তথ্য সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং-এর একটি পরিপূর্ণ গাইডলাইন প্রস্তুত করে। ২০১৯ সালের ৯ই অক্টোবর জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল এর সাথে সমন্বিত একটি সভার মাধ্যমে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত সংগঠনসমূহের কাছ থেকে মতামত গ্রহণ করে। সভায় টিসিআরসির প্রস্তাবনাটি মৌখিকভাবে স্বীকৃত হয়।
স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং এর প্রয়োজনীতা: বিভিন্ন বাজার হতে প্রাপ্ত তামাকপণ্যের মোড়কে দেখা যায় সাইজের ভিন্নতা, দূর্বল মোড়কজাতকরণ, কোম্পানীর পরিপূর্ণ নাম ঠিকানা না থাকা, একই নাম ও ব্যান্ডে ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির পণ্য বাজারজাত করা, ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের প্লাস্টিকের মোড়ক, মোড়কের ভিন্নতা, পলি মোড়কের ব্যবহার , কাগজে প্রিন্ট করে তা মোড়কের গায়ে সেটে দেওয়া, বিড়ির জন্য পাতলা কাগজের মোড়ক, প্যাকেট বা মোড়কে উপাদান ও উৎপাদনের তারিখ না থাকা ইত্যাদি দূর্বলতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও একই নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন কোম্পানি একই ডিজাইনে মোড়ক তৈরির পাশাপাশি বিদেশী মোড়কের আদলে দেশি মোড়ক তৈরি করছে। এর মাধ্যমে মূলত রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া ও ব্যবহারকারীকে ধোঁকায় ফেলানো হয়। সাদা পাতা, খোলা তামাক ও খুচরা শলাকা বিক্রয়ও রাজস্ব ফাঁকি এবং সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের অন্যতম অন্তরায়। তামাকপণ্যের মোড়কীকরণের এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং প্রবর্তন।
প্রস্তাবিত স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং: বিড়ির ক্ষেত্রে- বিড়ির মোাড়ক অবশ্যই সিগারেটের মোড়কের অনুরূপ অর্থাৎ শুধুমাত্র মোটা কাগজ দিয়ে তৈরী করতে হবে। ২০ শলাকার নিম্নে মোড়ক বাজারজাত করা যাবে না। স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং-এর বিধি মোতাবেক নির্দিষ্ট মাপের হতে হবে; মোড়কের পার্শ্বদেশে “১৮ বছরের কম বয়সী ব্যক্তির নিকট বিক্রয় করা বা তাকে দিয়ে বিক্রয় করানো যাইবে না” বিবৃতি থাকতে হবে। মোড়কে অবশ্যই শলাকা সংখ্যা ও খুচরা মূল্য উল্লেখ থাকতে হবে। ট্রান্সপারেন্ট ব্যান্ড রোল ব্যবহার করতে হবে অথবা মোড়কের পার্শ্বদেশে ব্যান্ড রোল দিতে হবে যাতে ছবি ঢেকে না যায়। বিধিমালায় উল্লেখিত তথ্য ছাড়া অন্য কোন তথ্য বা ছবি যেমন: মালিকের ছবি বা ”উৎকৃষ্ট তামাক পাতা থেকে তৈরী” জাতীয় কোন লেখা মোড়কে দেওয়া যাবে না।
জর্দ্দা ও গুলের ক্ষেত্রে: সকল জর্দ্দা ও গুলের কৌটা/মোড়ক একই রকম হবে, শুধুমাত্র টিনের কৌটা ব্যবহার করতে হবে; টিন ব্যতীত মোড়ক বাজারজাত করা যাবে না। স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং-এর বিধিমালা অনুযায়ী কৌটা বানাতে হবে; জর্দ্দার জন্য অনূন্য ৫০ গ্রাম ও গুলের জন্য অনূন্য ২০ গ্রামের নিম্নে কৌটা বাজারজাত করা যাবে না। কৌটার উপর লেবেল প্রিন্ট করা বাধ্যতামূলক। কোন রকম স্টিকার, কাগজ ইত্যাদি সেটে দেওয়া যাবে না; কৌটার ঢাকনা/মুখের উপরাংশে “১৮ বছরের কম বয়সী ব্যক্তির নিকট বিক্রয় করা বা তাকে দিয়ে বিক্রয় করানো যাইবে না” বিবৃতি থাকতে হবে। মোড়কে অবশ্যই ওজন ও খুচরা মূল্য উল্লেখ থাকতে হবে, কৌটার নিচে বৈধ ট্রেড মার্ক উল্লেখ থাকতে হবে। বিধিমালায় উল্লেখিত তথ্য ছাড়া অন্য কোন তথ্য বা ছবি যেমন: মালিক পক্ষের ছবি বা “স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়” জাতীয় কোন লেখা মোড়কে দেওয়া যাবে না।
বিড়ি, জর্দ্দা ও গুল সব মোড়কের ক্ষেত্রেই- সকল প্রকার বিড়ি, জর্দ্দা ও গুলের মোড়ক প্রস্তাবিত স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং-এর আওতাধীন হবে। সব মোড়কেই সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধি অনুযায়ী দিতে হবে। মোড়কে স্পষ্টভাবে উপাদান ও উৎপাদনের তারিখ থাকা বাধ্যতামূলক হতে হবে। বিধিমালায় উল্লেখিত নির্দিষ্ট সময় পর পর ছবি পরিবর্তন করতে হবে। কোন ব্যান্ড এলিমেন্ট ব্যবহার করা যাবে না। কোম্পানীর নাম ও সঠিক ঠিকানা স্পষ্ট করে লিখতে হবে। মোড়কের পার্শ্বদেশে “শুধুমাত্র বাংলাদেশে বিক্রয়ের জন্য অনুমোদিত” বিবৃতি থাকবে। এবং তামাকজাত দ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং সমভাবে প্রযোজ্য হইবে।
স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং-এর সুবিধা: স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং একই সাথে জনম্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করবে। ভোক্তার অধিকার সুরক্ষিত হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর বৃদ্ধিতে ও সংগ্রহ করতে সাহায্য করবে। ওজন, উপাদান, উৎপাদনের তারিখ ইত্যাদি উল্লেখ থাকায় বিএসটিআই-এর বিধিমালা অনুযায়ী মোড়কের মান সম্পন্ন হবে। সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মনিটরিং সহজতর হবে। যুবসমাজকে তামাকপণ্য গ্রহণে নিরুৎসাহিত করা। ধুমপায়ীদের ধুমপান পরিহারে সহায়তা করা। বিনামূল্যে মানুষকে তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করা ও নিরক্ষর ব্যক্তিদের সহজেই তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করা সম্ভবপর হবে।
সুপারিশমালা:
১. পানের সাথে জর্দ্দা বিক্রয় ও বিড়ির খুচরা শলাকা বিক্রয় বন্ধ করা;
২. সাদা পাতা ও খোলা তামাককে মোড়কের আওতায় আনা;
৩. স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং সকল ধরনের তামাকপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা;
৪. প্রস্তাবিত স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং অতিসত্বর পাশ করা এবং আগামী ১২ মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করা;
৫. এনবিআর-এর তালিকাভুক্ত তামাক কোম্পানিকেই আগে স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং-এর আওতায় আনা, বিশেষ করে ধোঁয়াবিহীন তামকপণ্যের ক্ষেত্রে;
৬. পরিবেশকদের টার্গেট করে সকল অবৈধ তামাক কোম্পানিকে এনবিআরএর তালিকাভুক্ত করা ও আইন মানতে বাধ্য করা;
লেখক: ফারহানা জামান লিজা, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও গবেষণা সহকারী, টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি