প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার
আমিন-উল-আহসান । আমাদের আত্নতৃপ্তির জায়গা এই যে, আমরা জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি সবার আগে সমর্থন করেছি। দ্রুততম সময়ে এফসিটিসি অনুস্বাক্ষর করেছি এবং সেই আলোকে আমরা ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০৫ প্রণয়ন করেছি। আমাদের সন্তুষ্টির জায়গা এটা যে, আমরা আইনের অধিকতর বাস্তবায়নের জন্য ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করেছি। আইন বাস্তবায়নের জন্য বিধিমালাও প্রণয়ন করেছি। তামাকজাত পণ্যের মোড়ক এবং এর ৫০ শতাংশ জায়গা জুড়ে ছবিযুক্ত স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মূদ্রণ করা হয়েছে। তামাকজাত দ্রব্যে ১% হারে সারচার্জ আরোপ এবং স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ব্যবস্থাপনা নীতি পাশ করা হয়েছে।
এছাড়াও সরকারের সপ্ত-পঞ্চবাষিকী কর্মপরিকল্পনা এবং অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাল্টিসেক্টোরাল এ্যাকশন প্ল্যানে তামাক নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে আইন ও বিধি প্রণয়ন ঠিক মতোই এগিয়েছে। কিন্তু, জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর তামাক নিয়ন্ত্রণ ম্যালেরিয়া কিংবা পোলিও নির্মূলের মতো সহজ কোনো কাজ নয়! ম্যালেরিয়া জীবাণুর কোন অর্থনীতি নাই কিন্তু, তামাকের অর্থনীতি আছে। ম্যালেরিয়া জীবাণুর কোন পক্ষ কিংবা কোন সংগঠন নাই কিন্তু, তামাকের একটা পক্ষ আছে, সংগঠন আছে আর সেই পক্ষ এবং সেই সংগঠন অনেক শক্তিশালী। কাজেই তামাক নিয়ন্ত্রণের কৌশলপত্র অন্য যে কোন রোগ নিয়ন্ত্রণের কৌশলপত্রের মত সরল রৈখিক নয়।
একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই তামাক কোম্পানির উদ্দেশ্য ‘মুনাফা অর্জন’। কাজেই তামাক কোম্পানী সমূহের স্বার্থ আর জনগনের স্বাস্থ্য রক্ষায় যারা তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন তাদের স্বার্থ কখনোই কোন দিন কান একটি বিন্দুতে মিলবে না বরং এই দুই পক্ষের স্বার্থ ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ বিপরীতার্থক। এই সমীকরণটি তামাক নিয়ন্ত্রণকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছে। একদিকে তামাক একটি বৈধ পণ্য, অর্থাৎ- তামাকের ব্যবসা নিষিদ্ধ নয়। অন্যদিকে, এই তামাকের ব্যবসা প্রসারের সাথে সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষ তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রশ্ন চলে আসে, তাহলে তামাক নিয়ন্ত্রণ হবে কিভাবে? তামাক কোম্পানী আর যারা তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন তাদের সাথে সম্পর্ক কিভাবে নির্ধারিত হবে? এই বিষয়গুলোকে সহজ করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক গ্রহিত তামাক নিয়ন্ত্রণে বৈশি^ক চুক্তি এফসিটিসি’র (ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল) অনুচ্ছেদ ৫.৩।
এফসিটিসি’র ৫.৩ অনুচ্ছেদ জনস্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য দেশের আইনকে তামাক কোম্পানির আগ্রাসন থেকে বাঁচানোর ‘রক্ষাকবচ’। এই অনুচ্ছেদের মূল কথা হলো “প্রতিটি দেশ তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রহীত নীতি এবং আইনকে তামাক কোম্পানির বাণিজ্যিক এবং কায়েমী স্বার্থ থেকে রক্ষা করবে।” এর মূল লক্ষ্য হলো তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তামাক কোম্পানির প্রভাবমুক্ত রাখতে রাষ্ট্রসমূহকে সহযোগিতা প্রদান করা।
এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩-তে বলা হয়েছে, এতে সমর্থনকারী রাষ্ট্রসমূহ তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতি ও তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিতে তামাক কোম্পানীর হস্তক্ষেপ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে। তামাক কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করবে এবং যে সকল ক্ষেত্রে যোগাযোগ করা হবে তার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। তামাক কোম্পানীর সাথে অংশীদারিত্ব বা শর্তহীন অপ্রয়োগযোগ্য চুক্তি করবে না, তামাক কোম্পানী কর্তৃক প্রদানকৃত তথ্যের স্বচ্ছতা ও সত্যতা নিশ্চিত করবে এবং তামাক কোম্পানীর সামাজিক দায়বদ্ধতার আওতায় কর্মসূচী নিয়ন্ত্রণ করবে। এছাড়াও আরো কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে এ অনুচ্ছেদে।
তবে অনুচ্ছেদটি বাস্তবায়নে চারটি নীতি নির্ধারণী বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ;
-
- জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত নীতি ও তামাক কোম্পানির স্বার্থ সম্পূর্ণ বিপরীত মুখী; এ দুয়ের মাঝে মৌলিক দ্বন্দ্ব কখনো মীমাংসা যোগ্য নয়।
- জনস্বার্থে তামাক নিয়ন্ত্রণ কোম্পানির সাথে সরকারের সকল ধরনের যোগাযোগ স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে।
- তামাক কোম্পানি এবং এর স্বার্থ নিয়ে যারা কাজ করে তাদের কার্যক্রম সরকারের নিকট জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ হতে হবে।
- যেহেতু তামাক কোম্পানী মরণঘাতি পণ্য উৎপাদন করে কাজেই তামাক কোম্পানিকে তাদের ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার কোন ধরনের সুবিধা দিবে না।
আক্ষেপের বিষয় হলো, মন্ত্রণালয় এবং মাঠ পর্যায়ে অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তা কিংবা বেসরকারি জনস্বাস্থ্য কর্মীদের মধ্যে এফসিটিসি’র এই গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নেই। তাছাড়া এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কোন গাইডলাইন প্রণীত হয়নি।
তামাক নিয়ন্ত্রণে এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩ একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। কাজেই কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নীতি নির্ধারণের সকল ক্ষেত্রে এই অনুচ্ছেদটির উপযুক্ত চর্চা ও এ সংক্রান্ত গাইডলাইন প্রণয়ণের অপরিহার্যতা রয়েছে। পাশাপাশি এফসিটিসি’র অধিক বাস্তবায়নে সরকারী-বেসরকারীগুলো তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ প্রণয়ন করতে পারে। এখনই তার উপযুক্ত সময়।
লেখক: পরিচালক (অর্থ), বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্পোরেশন