প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার
ইব্রাহীম খলিল ॥ পর্তুগিজদের হাত ধরে ১৫০৮ সালের দিকে এ উপমহাদেশে তামাক আসার পর আজ অবধি এর চাষ চলছেই। একইসঙ্গে এর ব্যবসা সম্প্রসারণে তামাক কোম্পানি সব কালেই সরকারের সহায়তা পেয়েছে । ফলে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা নানা সময়ে তামাকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেও ঠিক কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া সম্ভব হয়নি। অথচ তামাকজনিত রোগের কারণে দেশে মৃত্যুর সারি দীর্ঘ থেকে আরো দীর্ঘতর হচ্ছে। একইসঙ্গে সরকারকে ব্যয় করতে হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে বিশে^র বিভিন্ন দেশে তামাক চাষ সীমিত হয়ে আসলেও বাংলাদেশে ক্রমেই তা বেড়ে চলেছে। ফলে কৃষক থেকে শুরু করে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পুরো দেশ।
গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকের কাঁচা পাতার সংস্পর্শে থাকা, জমিতে প্রচুর কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করার কারণে কৃষকরা নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। এ থেকে সৃষ্টি হচ্ছে গ্রিন টোব্যাকো সিকনেস নামক একধরনের রোগ। এছাড়া তামাক গাছ মাটির পুষ্টি দ্রুত শেষ করে ফেলে। ফলে জমিতে প্রতিবার চাষের আগে অধিক পমিাণে রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয়। আস্তে আস্তে জমির উর্বরতাও নষ্ট হতে থাকে এবং একসময় ওই জমিতে আর কোন ফসলেরই ভালো ফলন হয় না।
অন্যদিকে তামাক পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে বিশেষভাবে তৈরী চুল্লি ঘরে ৭২ ঘণ্টা তাপমাত্রা একই পরিমাণে ধরে রাখতে প্রচুর পরিমাণে খড়, ভূষি ও কাঠ পোড়ানো হয়। ফলে একদিকে যেমন বন উজাড় হয়ে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে গবাদী পশুর খাদ্যও নিঃশেষ হচ্ছে। কারণ ধান, গম, ভূট্টা, সরিষা ও নানা ধরনের সবজিসহ অন্যান্য ফসল চাষ হলে গৃহপালিত প্রাণীর খাদ্যের অভাব হয় না। কিন্তু তামাক গাছ বা পাতার কোন অংশই প্রাণীর খাবার যোগ্য নয়। ফলে এসব এলকায় হাঁস, মুরগি ছাগল এমন গৃহপালিত প্রাণীর সংখ্যাও অনেক কম। যার কারণে এসব এলাকার শিশু থেকে শুরু করে বড়োরাও পর্যাপ্ত দুধ-মাংস-ডিম খেতে না পারায় পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।
ব্যবসায়িক স্বার্থে তামাক কোম্পানিগুলো দেশে তামাক চাষ কমে আসছে বলে দাবি করলেও বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য ও গণমাধ্যমে আসা বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট যে তামাকের চাষ কোথাও কিছুটা কমলেও অনেক জায়গাতেই উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। একইসঙ্গে সিলেট, কুষ্টিয়া, রংপুর ও বান্দরবানের মতো জায়গায় নতুন করে তামাক চাষ বাড়ছেই।
এখন প্রশ্ন হলো, কৃষকরা যে লাভের আশায় তামাক চাষ করছে তাতে তারা কতোটা লাভবান হচ্ছে? একইসঙ্গে তামাক কোম্পানিগুলো যেভাবে কৃষকদের লাভের কথা প্রচার করছে তার বাস্তবতাটাইবা কতোটুকু? একইসঙ্গে তামাক চাষে নানা ধরনের ক্ষতি হলেও মানুষকে কেনো এটা থেকে দূরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না?
এসব প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়া সম্ভব নয়। তবে ক্ষতিকর দিক জেনেও কৃষকদের তামাক চাষ করার আগ্রহের পিছনের প্রধান কারণ কৃষকদের অধিক আর্থিক স্বচ্ছলতার আকর্ষণ এবং তামাক কোম্পানিগুলোর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা। তবে কৃষকরা লাভের আশায় তাৎক্ষণিক কিছুটা নগদ আর্থিক সুবিধা পেলেও তারা আসলেই কতোটা সুবিধাভোগী হচ্ছে সেটা প্রশ্ন জাগায়। গবেষণা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা’ (উবিনীগ) তাদের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, কৃষক তামাককেই প্রধান ফসল বিবেচনা করায় নগদ অর্থের প্রলোভনে অন্য ফসল চাষের পরিকল্পনা করতে পারে না। ফলে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগী পালনসহ অন্যান্য কৃষিকর্মও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
তামাকের জমিতে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের ব্যবহার করার কারণে তামাকের জমি থেকে নদী, জলাশয়ের মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতি হয়। এতে জীব-বৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং মানুষের পুষ্টির যোগান বন্ধ হয়ে যায় ফলে শিশুসহ সকলে পুষ্টিহীনতায় ভোগে। অন্যদিকে তামাকের ক্ষেতে অধিক মাত্রায় কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের প্রয়োগ এবং তামাক চাষ ও বিক্রির জন্য প্রস্তুত করে তোলার প্রক্রিয়ায় কৃষক, শ্রমিক, নারী ও শিশু নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। একইসঙ্গে তামাক পোড়ানোর সময় নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে হওয়ায় শিশুদেরকেও কাজে লাগানো হয়। এ সময় কারা স্কুলে যেতে পারে না, ফলে তারা শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। পাশাপাশি অল্প বয়সেই শরীওে বাসা বাঁধে নানা ধরনের রোগ।বর্তমানে বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৫ দশমিক ৭৭ লক্ষ হেক্টর জমি। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে মোট ১ লাখ ৪ হাজার ৯১৪ একর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। তবে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশে তামাকের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সবজি চাষ হলেও তামাককেই অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও তামাকের চেয়ে সবজিতে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসলেও কোনো এক অজানা কারণে বাংলাদেশে তামাকেই কর্তাদের আগ্রহ বেশি। যেটা আসলেই ভীষণ উদ্বেগের বিষয়।
চলতি অর্থ বছরে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৪৬ কোটি ৬০ লাখ ৫৬ হাজার ৮০ টাকার তামাকজাত পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এর বিপরীতে ১৪৬১ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার ২৮১ টাকার সবজিপণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। যা তামাকের চেয়ে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বেশি। তবে তামাক চাষ ও ব্যবহার নিয়ে অনেক আক্ষেপ থাকলেও দেশকে তামাকমুক্ত করতে বর্তমান সরকারের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। কারণ পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গড়ার অঙ্গিকার ব্যক্ত করেছেন। ফলে তিনি যেহেতু তামাকমুক্ত দেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন তাই এটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বাস্তবায়ন হবে বলে বিশ্বাস করি।
লেখক : ইব্রাহীম খলিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো’র তামাক কর বিষয়ক প্রকল্পে প্রকল্প কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।