প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার
‘ধূমপানে বিষপান’, ‘তামাক মৃত্যু ঘটায়’- বছরের পর বছর এসব সতর্কবাণী প্রচলিত থাকলেও জনসাধারণে এগুলোর প্রভাব কতটা তা দেশের তামাক ব্যবহারকারী ও তামাকজনিত রোগে মৃত্যুর সংখ্যার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। জনসংখ্যার আধিক্য, নিম্নআয়, দারিদ্র্যতা, অসচেতনতা এবং নানাাবিধ কারণে বিশ্বের সর্বোচ্চ তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারি দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
সম্প্রতি প্রাপ্ত তথ্য মতে, বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার ২৬০ জন মানুষ মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল এ্যাডাল্ট ট্যোবাকো র্সাভে (গেটস) ২০১৭ অনুসারে, দেশের ১৫ বছরের উর্ধ্বে মোট জনসংখ্যার ৩৫.৩% অর্থাৎ ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাকজাত পণ্য সেবন করে। পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হয় আরো ৪ কোটি ৮ লাখ মানুষ।
বাংলাদেশ সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণে FCTC (Framework Convention on Tobacco Control) আন্তর্জাতিক এই কনভেনশনে ২০০৩ সালে প্রথম স্বাক্ষর করে। সমন্বিত তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫’ এবং পরবর্তীতে এই আইনের সংশোধন করে ২০১৩ সালে এবং এরই অনুবৃত্তিক্রমে ২০১৫ সালের মার্চ মাসে বিধিমালা প্রণয়ন করে। তাছাড়া এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) এর ৩ নং লক্ষ্যমাত্রায় এফসিটিসি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেও তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মকা-কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং ২০৪০ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করতে সকল পর্যায়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি।
ইপসা তার সূচনা লগ্ন থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৯৯ সালে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানী কর্তৃক পরিচালিত চট্টগ্রাম বন্দরে ”ভয়েস অব ডিসকভারী ক্যাম্পেইন” বন্ধে চট্টগ্রামে ইপসা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইপসা ২০০৯ থেকে ধূমপানমুক্ত পরিবেশ তৈরী এবং তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান (চট্টগ্রাম, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন, ফেনী, নোয়াখালী, কক্সবাজার, চাঁদপুর, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পৌরসভা) তাদের নিজ নিজ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য ধূমপানমুক্ত গাইডলাইন তৈরী করেছে এবং অনুমোদন করেছে যা বাংলাদেশে প্রথম।
তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন এবং স্থায়ীত্বশীল করতে হলে অবশ্যই স্থানীয় পর্যায়ে অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। সে লক্ষ্যে বিগত ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছর থেকে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান তাদের বার্ষিক বাজেটে ধূমপান ও তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দ রাখে এবং এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর উক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ বাজেট বরাদ্দ রেখে আসছে।
২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৩২ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২০ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বরাদ্দ রাখছে ২ কোটি টাকা যা সারা বাংলাদেশের জন্য উদাহরণস্বরূপ। চট্টগ্রাম বিভাগের এ উদ্যোগ অনুসরন করে বাংলাদেশে আরো ৬২টি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান তামাক নিয়ন্ত্রণে অর্থ বরাদ্দ রাখছে।
তবে এ বরাদ্দকৃত বাজেট এর কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নানাবিধ সীমাবদ্ধতার কারণে বেশীরভাগ সময়ে এ বাজেট অব্যবহৃত থেকে যায়। বরাদ্দকৃত বাজেট ও ব্যয়িত বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বরাদ্দকৃত বাজেটের চেয়ে এই খাতে খরচ করা হয়েছে খুবই কম। বিগত ৭ বছরে ১১টি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মোট বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১২ কোটি ২৮ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা এবং ব্যয় হয়েছে ৯৯ লক্ষ ৩১ হাজার ৫ শত টাকা।
মূলত এ বাজেট বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং সাইনেজ প্রিন্ট এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ তামাক নিয়ন্ত্রণে আরো নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে যেমন: জনপ্রতিনিধি এবং কর্মকর্তাদের জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বিষয়ক প্রশিক্ষণ, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা, স্যানিটারী ইন্সপেক্টর কর্তৃক তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহণ পরিদর্শন, আইন বাস্তবায়ন মনিটরিং করা এবং আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ, সকল ওয়ার্ডে ওয়ার্ড কাউন্সিলর এর তত্ত্বাবধানে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনের মালিক এবং বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিেেদর সাথে সচেতনতামূলক সভা করা এবং তাদেরকে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা ইত্যাদি। তাছাড়া মাসিক সমন্বয় সভায় তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়টিকে এজেন্ডাভূক্ত করা; নিয়মিত প্রতিবেদন প্রদান করা; একজন ফোকাল পার্সন নির্ধারণ করার মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমসমূহের সমন্বয় সাধন করা; তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রয়োগ করতে টাস্কফোর্স কমিটির নিয়মিত সভায় উপস্থিত থেকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সহায়তা করা; প্রিন্ট, ইলেকট্রোনিক এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এর বেশী বেশী প্রচারণা; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশে পাশে তামাকজাত দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা; লাইসেন্স প্রণয়নের মাধ্যমে তামাকের ক্রয় বিক্রয় সীমিত করার ক্ষেত্রেও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ কাজ করতে পারে।
“শুধুমাত্র বাজেট বরাদ্দ করলেই চলবে না বরং সত্যিকার অর্থে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট ব্যবহারের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। পাশাপাশি একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা টীমের মাধ্যমে নিয়মিত মনিটরিং ও সমন্বয় করে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। এছাড়া বরাদ্দকৃত বাজেট খরচ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে হতে হবে অনেক বেশি আন্তরিক।”
চট্টগ্রাম বিভাগের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের এ উদ্যোগ সারা বাংলাদেশে অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে প্রতিরূপায়িত হয়েছে। বর্তমানে এ উদ্যোগটি সারা বাংলাদেশের সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে প্রতিরূপায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি অভিন্ন তামাক নিয়ন্ত্রণ গাইডলাইন অনুমোদন করা হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে বাজেট বরাদ্দ এবং এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ইপসা এ কাজের একজন অংশীদার। সুতরাং এ গাইডলাইন বাস্তবায়নের মাধ্যমেও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে।
সুপরিকল্পিতভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, জেলা পরিষদ কিংবা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষকে এ সম্পর্কিত নানা কার্যক্রম পরিচালনা করা অতীব প্রয়োজন। আর এজন্য স্থানীয় সরকারের এই পর্যায়গুলোতে তামাক নিয়ন্ত্রণে বেশি বেশি বাজেট বরাদ্দ এবং পরিকল্পিত উপায়ে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা জরুরি।
সুতরাং শুধুমাত্র উদ্যোগ গ্রহণ নয়, উদ্যোগের সঠিক ও শক্তিশালী বাস্তবায়নের মাধ্যমে সারাদেশে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশে তৈরীর কাজটি অনেক সহজ হবে।
লেখক: নাছিম বানু, উপ পরিচালক (সামাজিক উন্নয়ন বিভাগ), ইয়ং পাওয়ার ইন সোস্যাল এ্যাকশন (ইপসা)