প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার
এস এম নাজের হোসাইন ॥ ‘এমনিতেই বড় আঁধার এখানে/এমনিতেই বড় ধুঁকে ধুঁকে বাঁচি/ধোঁয়ায় ভিষণ চোখ জ্বালা করে/ফুসফুসে বিষ ঢেলোনা।’ কথাগুলো ফারজানা ওয়াহিদ সায়ানের ‘নিকোটিন’ গানের। পৃথিবীর কম ধূমপায়ী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ঘানা, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, ইরিত্রিয়া এবং পানামা।
এসব দেশে ধূমপান ও তামাকপণ্য ব্যবহারের প্রবণতা হ্রাস পাওয়ার কারণগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ধূমপান ও তামাকপণ্য রোধে এইসব দেশের সরকারের কঠোর ও কার্যকর ভূমিকা পালন। উচ্চহারে কর আরোপ যার অন্যতম কারণ। এসব দেশে যারা ধূমপান করে তাদের অত্যন্ত উচ্চদাম দিয়ে সিগারেট কিংবা তামাকপণ্য সংগ্রহ করতে হয়। ধূমপানে আসক্তি তৈরির আগেই উচ্চদামের কারণে অধিকাংশ মানুষই ধূমপানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। মানুষের অনাগ্রহের কারণে তামাকজাত কোম্পানিগুলো গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে নিজেদের ব্যবসা। ফ্রান্সও ধূমপান রোধে দ্রুত অগ্রগতি লাভ করছে।
এখানেও লক্ষ্য করলে দেখা যায় তামাকপণ্যে উচ্চহারে কর বৃদ্ধি ও তার যথাযথ প্রয়োগ অন্যতম ভূমিকা পালন করছে। আবার জনসংখ্যা হারে সবচেয়ে বেশি ধূমপায়ী দেশগুলো হলো কিরিবাতি, মন্টেনিগ্রো, গ্রিস, পূর্ব তৈমুর ও রাশিয়া। ধূমপান রোধে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর সাথে এসব দেশের পার্থক্য খুঁজলে দেখা যায়, এসব দেশে সিগারেট অত্যন্ত সহজলভ্য এবং খুব কম দামেও পাওয়া যায়। যার ফলস্বরূপ জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ দ্রুত এসব মরণব্যাধি ধূমপানে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এতক্ষণ বিভিন্ন দেশের ধূমপান রোধে সফল ও ব্যর্থ দেশগুলোর কথা বলা হয়েছে। আমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছি আমাদের দেশের নাম কোন দেশগুলোর পাশে বসবে?
হ্যাঁ আপনার অনুমান সঠিক, সবচেয়ে বেশি ধূমপায়ী দেশগুলোর আশপাশে আছে আমাদের দেশ। বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের। গ্লোবাল এ্যাডাল্ট টোবাকো সার্ভে (গ্যাট্স) এর ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। এদের মধ্যে ধূমপায়ী ১৮ শতাংশ (১ কোটি ৯২ লক্ষ) এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী ২০.৬ শতাংশ (২ কোটি ২০ লক্ষ)। শহরের জনগোষ্ঠির (২৯.৯%) তুলনায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠির (৩৭.১%) মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার অনেক বেশি। এসব পরিসংখ্যানের পেছনের বাস্তবতা হলো সিগারেট ও তামাকপণ্যের সহজলভ্যতা ও কম দাম। ৩৫/৪০ টাকা দিয়ে দেখা যায় একপ্যাকেট সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে। বেনসন সিগারেট উন্নত বিশ্বে সংগ্রহ করতে যেখানে খরচ করতে হয় ১৪/১৫ ডলার সেখানে আমাদের দেশে সেটি পাওয়া যায় ২৩৫/২৪০ টাকায়। যা ডলারে ২.৫০ হয়। এমন কম দাম আর সহজলভ্যতা লাগামহীন ভাবে ছুটে গ্রাস করে নিচ্ছে তারুণ্যের জীবনীশক্তি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে এই মরণঘাতী।
গবেষণায় দেখা গেছে, করারোপের ফলে তামাকের প্রকৃতমূল্য ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে তামাকের ব্যবহার ৫ শতাংশ হ্রাস পাবে। অবশ্য শুধু করারোপ করাটাই একমাত্র সমাধান নয়। প্রতিবছরই দেখা যায় তামাকপণ্যের উপর করারোপ করা হয়ে থাকে কিন্তু এতে শুভংকরের ফাঁকি আছে। যেটুকু করারোপ করা হয়ে থাকে তা কোনভাবেই তামাকপণ্যে নিরুৎসাহিত হবার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ প্রতিবছর যেটুকু করারোপ করা হয়ে থাকে এবং করারোপের কারণে কোম্পানি যে দাম নির্ধারণ করে তা সাধারণ মানুষের জন্য সহনশীল মাত্রায় থাকে। প্রতি দুয়েক বছর পর সিগারেটের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে দেখা যায় মানুষের আয়ও বৃদ্ধি পায়। যার কারণে অল্পহারে দামবৃদ্ধি পেলেও তা সাধারণ মানুষের তামাক আসক্তিতে কোন প্রভাব রাখেনা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ সালের তুলনায় ২০১৭-১৮ সালে মাথাপিছু জাতীয় আয় (নমিন্যাল) বেড়েছে ২৫.৪ শতাংশ। অথচ এসময়ে বেশিরভাগ তামাকপণ্যের দাম হয় অপরিবর্তিত থেকেছে অথবা সামান্য পরিমাণে বেড়েছে।
আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয় একাধিক মূল্যস্তর থাকার কারণে উচ্চস্তরের সিগারেট নিম্নস্তরের সিগারেট দেখিয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা। এর কারণে যেমন জনসংখ্যার বিশাল অংশ স্বাস্থ্য ঝুঁঁকিতে রয়েছে তেমনি সরকারও বঞ্চিত হচ্ছে বিশাল অংকের রাজস্ব থেকে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ : এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। একই সময়ে তামাকখাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয় ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের চেয়ে তামাক ব্যবহারে অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের তথ্যমতে, পৃথিবীতে যেসব দেশে সিগারেটের মূল্য অত্যন্ত কম তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। তাই ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে আমাদের প্রত্যাশা, তাই তামাকপণ্যে কার্যকর ও বর্ধিত হারে করারোপ অত্যন্ত করা হোক। নিম্নোক্ত সুপারিশগুলো যদি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়, তবে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রায় ৩.২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী (১.৩ মিলিয়ন সিগারেট ধূমপায়ী এবং ১.৯ মিলিয়ন বিড়ি ধূমপায়ী) ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবে; সিগারেটের ব্যবহার ১৪% থেকে হ্রাস পেয়ে প্রায় ১২.৫% এবং বিড়ির ব্যবহার ৫% থেকে হ্রাস পেয়ে ৩.৪% হবে; দীর্ঘমেয়াদে ১ মিলিয়ন বর্তমান ধূমপায়ীর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে এবং ৬ হাজার ৬৮০ কোটি থেকে ১১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার মধ্যে (জিডিপি’র ০.৪ শতাংশ পর্যন্ত) অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে।
সুপারিশসমূহ হলো -সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা ৪টি থেকে কমিয়ে ২টিতে (নিম্ন এবং উচ্চ) নিয়ে আসা। অর্থাৎ নিম্ন ও মধ্যম স্তরকে একত্রিত করে একটি মূল্যস্তর (নিম্নস্তর) এবং উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরকে একত্রিত করে আরেকটি মূল্যস্তরে (প্রিমিয়াম স্তর) নিয়ে আসা; নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারটের খুচরা মূল্য নূূন্যতম ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে ৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; প্রিমিয়াম স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য নূন্যতম ১২৫ টাকা নির্ধারণ করে ৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১৯ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।
বিড়ির ফিল্টার এবং নন-ফিল্টার মূল্য বিভাজন তুলে দেওয়া। অর্থাৎ ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৪০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক ও ৬.৮৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা এবং ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৩২ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক ও ৫.৪৮ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। এবং একটি সহজ এবং কার্যকর তামাক কর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন (৫ বছর মেয়াদি) করা, যা তামাকের ব্যবহার হ্রাস এবং রাজস্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে; সকল প্রকার ই-সিগারেট এবং হিটেড (আইকিউওএস) তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি এবং বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা; কঠোর লাইসেন্সিং এবং ট্রেসিং ব্যবস্থাসহ তামাক কর বাস্তবায়নে প্রশাসনকে শক্তিশালী করা, কর ফাঁকির জন্য শাস্তিমূলক জরিমানার ব্যবস্থা করা।
সারাবিশ্বের কাছে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে একটা দেশ ও জাতির সমস্ত অগ্রযাত্রা ম্লান করে দিতে পারে ছোট্ট কোন ভুল কিংবা অসচেতনতা। নতুন প্রজন্মের সামনে সুন্দর ভবিষ্যৎ আগামী ও নিষ্কটক পৃথিবী রেখে যেতে হলে অন্যান্য উন্নয়নের পাশাপাশি তামাকমুক্ত সুস্থ সুন্দর তারুণ্য গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মুজিববর্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত নিবেদন, তামাকপণ্যের আধিপত্য রোধে তামাকজাত পণ্যের প্রতি উচ্চহারে করারোপ করা হোক এবং যত্রতত্র তামাকপণ্য বন্ধে বিক্রয়কর্মীদের লাইসেন্স বাধ্যতামুলক করা হোক। নতুন প্রজন্মের আকাশ মুক্তি পাক বিষাক্ত কালো ধোঁয়া থেকে এই কামনায় করি।
লেখক: এস এম নাজের হোসাইন, ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ই-মেইল:cabbd.nazer@gmail.com