News
তামাকজাত পণ্যের মোড়কের সাইজ ভিন্নতার সুযোগ নিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছে বিভিন্ন তামাক কোম্পানি। একই কারণে তামাক পণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের ক্ষেত্রেও বিঘ্নতা ঘটছে। তামাক পণ্যের স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং প্রবর্তন ও সুনির্দিষ্ট কর আরোপ সম্ভব হলে কোম্পানিগুলোর কর ফাঁকি রোধ হবে এবং রাজস্ব আয় বাড়বে। যা দিয়ে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। পাশাপাশি সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বাস্তবায়ন সহজ ও কার্যকর হবে।
২৮ ডিসেম্বর ২০২১ সকাল ১১ টায় ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি’র নসরুল হামিদ মিলনায়তনে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন। টোব্যাকো কন্টোল রিসার্চ সেল (টিসিআরসি), ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভির্সিটি, ও বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট যৌথভাবে সেমিনার আয়োজন করে।
বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের সমন্বয়কারী সাইফুদ্দিন আহমেদ এর সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষনা ব্যুরো’র ফোকাল পার্সন অধ্যাপক ড. রুমানা হক। আলোচনা করেন প্রত্যাশা মাদক বিরোধী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হেলাল আহমেদ, ভাইটাল স্ট্রাটেজিস এর কান্ট্রি ম্যানেজার-বাংলাদেশ নাসির উদ্দীন শেখ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এস. এম আবদুল্লাহ, যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতনিধি সুশান্ত সিনহা। সেমিনারে সঞ্চালনা ও শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন টোব্যাকো কন্টোল রিসার্চ সেল’র সদস্য সচিব মো. বজলুর রহমান এবং মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা জামান লিজা।
প্রবন্ধে ফারহানা জামান লিজা বলেন, দেশে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক জনগোষ্ঠি বয়সে তরুণ এবং এরাই তামাক কোম্পানিগুলোর প্রধান টার্গেট। সস্তা ও সহজলভ্যতার কারণে বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার ও তামাকজনিত ক্ষয়-ক্ষতি অনেক বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ধোঁয়াযুক্ত তামাক থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব ছিল ২৬,৩৫৫ কোটি টাকা যেখানে ধোঁয়াবিহীন তামাক থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব ছিল মাত্র ৩১.৯৯ কোটি টাকা। মূলত ধোঁয়াবিহীন তামাকের রাজস্ব আদায়ে উদাসীনতা, অধিকাংশ তামাক কোম্পানি করের আওতায় না থাকা ইত্যাদি কারণে ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহারকারী বেশি হওয়া সত্ত্বেও এর থেকে সেই অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না। তামাক পণ্যের স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং এর মাধ্যমে দেশের ছোট বড় সকল তামাক কোম্পানিকে করের আওতায় আনা সম্ভব। পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর যথাযথ বাস্তবায়নে সহায়ক হতে পরে স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং।
সুশান্ত সিনহা বলেন, তামাকের কর বৃদ্ধির প্রসঙ্গ আসলে চোরাচালান বৃদ্ধি ও সরকারের রাজস্ব কমে যাওয়ার বিষয়টি সামনে আনা হয়। কিন্তু, আসল চিত্র ভিন্ন। প্রকৃতপক্ষে, এগুলো কোম্পানির প্রপাগান্ডা। ২০২০-২১ অর্থবছরে জর্দা থেকে রাজস্ব বেড়েছে প্রায় ৮.৭৫ কোটি এবং গুল থেকে বেড়েছে ১.৩১ কোটি টাকা। রাজস্ব বোর্ডের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য উপস্থাপন ও বাস্তবায়ন করা গেলে ধোঁয়াবিহীন তামাক কোম্পানিগুলোর রাজস্ব ফাঁকি রোধ করা যাবে। এর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় আরো বাড়ানো সম্ভব।
নাসির উদ্দীন শেখ বলেন, ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্যগুলোর উৎপাদন প্রক্রিয়া নিকৃষ্টতম। আমাদের দেশে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এবং আসক্তির কারণে এগুলোর ব্যবহার বেশি। তামাক কোম্পানিগুলোকে ওপেন লাইসেন্স দেওয়া রয়েছে। ফলে তারা লক্ষ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলছে এবং পঙ্গু করে ফেলছে। জনগণের কাছে ভ্যাট তুলে নিজেদেও মুনাফা থেকে সামান্য যোগ করে পুরোটাই নিজেদের ট্যাক্স বলে চালিয়ে দিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। কর বৃদ্ধিসহ সকল প্রক্রিয়ায় তামাক কোম্পানিগুলোর হস্তক্ষেপের কারণে আমরা কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারছি না।
এস এম আব্দুল্লাহ্ বলেন, স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং এর দুটি ভালো দিক রয়েছে। সেটি হচ্ছে- কর বৃদ্ধি ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা। এটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে যা পৃথিবীর অনেক দেশে কার্যকরের মাধ্যমে সফলতা এসেছে। এফসিটিসিতে স্বাক্ষরকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশেই তামাক নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অঙ্গীকার রয়েছে। যা কাজে লাগাতে হবে। তামাক পণ্যের ‘প্যাকেজিং’ ও ‘সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী’ এর বাস্তবায়ন বাজার মনিটরিং জরুরী। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে জানাতে হবে। তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে ‘লাইসেন্সিং’ এর গুরুত্ব রয়েছে। তামাক পণ্যের কর আদায়ের পদ্ধতি আধুনকিকীকরণ জরুরী। এক্ষেত্রে ‘ট্র্যাকিং’ ও ‘ট্রেসিং’ পদ্ধতি কাজে লাগাতে হবে।
আমিনুল ইসলাম বকুল বলেন, তামাকজাত দ্রব্য খুচরা বিক্রয় পর্যায়ে লাইসেন্সিং প্রবর্তন বিষয়ে দেশে কাজ বলছে। স্বানীয় সরকার বিভাগ এ বিষয়ে একটি গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে। প্যাকজিংয়ের দূর্বলতার কারণে তামাকের কর আদায়ে নানার জটিলতা দেখা দিচ্ছে। দূর্বলতা নিরসনে এনবিআরের প্রতি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলকে আরো শক্তিশালী করা উচিৎ, বলেন তিনি।
হেলাল আহমেদ বলেন, তামাকের কর বৃদ্ধিতে তামাক বিরোধী সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করে। কর বৃদ্ধিতে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দিলেও বাজেটে সেটার প্রতিফলন দেখা যায় না। কারণ, সরকারের মধ্যেই কিছু মানুষ আছে, যারা তামাক কোম্পানির স্বার্থে কাজ করে।
অধ্যাপক ড. রুমানা হক বলেন, দেশে জর্দা, গুলের উপর কর আরোপ করা হচ্ছে ২০০৩ এবং ভ্যাট আরোপ হচ্ছে ২০০৮ সাল থেকে। ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্যের কর কাঠামোতে পরিবর্তন এনে ২০১৯ সাল থেকে ট্যারিফ ভ্যালুর পরিবর্তে বিক্রয় মূল্যের উপর কর আরোপ করা হচ্ছে। এগুলো আমাদের সফলতা। তবে মোড়কে সাইজের ভিন্নতার কারণে ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্যে ‘ব্যান্ডরোল’ বসানো যায় না বলে কর ফাঁকির সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। এছাড়া সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মূদ্রণের উদ্দেশ্য ব্যহত হয়।
তামাক কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপন চালায় ভোক্তাকে প্রলুব্ধ করার জন্য। প্যাকেট এর মাধ্যমেও পণ্যের প্রচার করে তারা। এজন্য আমাদেরকে তামাক পণ্যের ‘স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং’ এবং ক্রমান্বয়ে ‘প্লেইন প্রাকেজিং’ দিকে যেতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং অকালমৃত্যু প্রতিরোধ করার জন্য। তামাক নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘এমপাওয়ার প্যাকেজ’ কাজে লাগাতে হবে বলে জানান তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, তামাক কর আদায়ের স্তর ও প্রক্রিয়ায় গলদ রয়েছে। এগুলো সংশোধন ও তামাক কর ব্যবস্থায় আধূনিকায়ন কিছু সমস্যা দুর করতে হবে। এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে তামাক কোম্পানির কর ফাঁকির বিষয় ও আমাদের প্রস্তাবনা সহজভাবে তুলে ধরতে হবে। স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বাস্তবায়ন, খুচরা ও খোলা তামাক পণ্য বিক্রয় বন্ধ ও কর বৃদ্ধি সম্ভব। এটি বাস্তবায়নে এনবিআরের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করা উচিৎ বলে মত ব্যক্ত করেন তিনি।
সেমিনারে বিভিন্ন তামাক বিরোধী সংগঠনের প্রতিনিধি, বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, গণমাধ্যম কর্মীবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।