স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজ তামাক নিয়ন্ত্রণ সাংবিধানিক দায়িত্ব

তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহারের প্রেক্ষিতে দেশের মানুষ তামাকজনিত রোগ ও মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হচ্ছে বিধায় স্বাস্থ্যহানি ভেষজ তামাক নিয়ন্ত্রণ সরকারের একটি সংবিধানিক দায়িত্ব। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় যত দ্রুত সম্ভব তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস জরুরি। আজ সকাল ১১টায় বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট ও ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট কর্তৃক আয়োজিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর পরিচালক এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম এর সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন নারীপক্ষ’র সভানেত্রী এডভোকেট ইউ এম হাবিবুন নেসা, সাংবাদিক চিন্ময় মুৎসুদ্দী, পরিবেশবিদ মহিদুল হক খান, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন এন্ড হসপিটাল এর সহযোগী অধ্যাপক ও ইউনাইটেড ফোরাম এগেইনস্ট টোব্যাকো (উফাত) এর সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী, এন্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা) এর আহবায়ক সাংবাদিক আবু রুশদ মো. রুহুল আমিন, বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট প্রতিনিধি ও প্রত্যাশা মাদক বিরোধী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হেলাল আহমেদ। সভায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর ন্যাশনাল এডভোকেসি অফিসার সৈয়দা অনন্যা রহমান ও সঞ্চালনা করেন সংস্থার প্রকল্প সমন্বয়কারী আমিনুল ইসলাম সুজন।

প্রবন্ধে সৈয়দা অনন্যা রহমান বলেন, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫ (ক) অনুসারে চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা এবং অনুচ্ছেদ ১৮ (১) জনগনের পুষ্টিস্তর উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্যের উন্নতি এবং ভেষজের নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে। তামাক একটি স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজ। এছাড়া সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ (ক) অনুচ্ছেদে পরিবেশ সংরক্ষন, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি রক্ষার কথা বলা হয়েছে। তামাক চাষ ও শুকানোর প্রক্রিয়ায় পার্বত্য এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বন উজার ও পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, দেশের খাদ্য জমি ধ্বংশ হচ্ছে। পরিবেশ, জীববৈচিত্র ও খাদ্য জমি রক্ষায় তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ সংবিধানিক দায়িত্ব।

চিন্ময় মুৎসুদ্দী বলেন, ধূমপান না করেও দেশের প্রায় ১ কোটি নারী পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক কোটি নারী যদি পরোক্ষ ধূমপানে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে এরা আগামী দিনে মা হবে। যদি ধরে নেয়া হয় এই এক কোটি নারীর মধ্যে ৫০ লক্ষ মা হবেন। যদি ৫০ লক্ষ সন্তানের মধ্যে ২৫ লক্ষ শিশু বিকলাঙ্গ বা পঙ্গু হয়, তবে তার দায়ভার কে নেবে? কারণ আমরা জানি, পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে বিকলাঙ্গ শিশু বা অকালে শিশু জন্মায। তাই পাবলিক প্লেস ও পরিবহনগুলো শতভাগ ধূমপানমুক্ত করা জরুরি।

এডভোকেট হাবিবুন নেসা বলেন, সংবিধান মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলেছে। এখন তামাক স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য হুমকি বিধায় কঠোরভাবে তামাককে নিয়ন্ত্রন করতে হবে। তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে, সামগ্রিকভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে আইন করতে হবে। মহিদুল হক খান বলেন, তামাক সেবনই শুধু মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে না। তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিশেষত বিড়ি-গুল-জর্দা কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তামাক চাষে সম্পৃক্ত কৃষকের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি কৃষিজমি ধ্বংস হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। তাই তামাককে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ছবিসহ সতর্কবাণী রেখে মন্ত্রীসভায় যে খসড়া অনুমোদিত হয়েছে সেটি যত দ্রুত অনুমোদিত হলেই সংসদ সদস্যদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা হবে। সাংবাদিক রুহুল আমিন রুশদ বলেন, মন্ত্রীসভায় আইনটি যে অবস্থায় অনুমোদিত হয়েছে সে অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব পাস করতে হবে। জনস্বাস্থ্য ও মানুষের মৃত্যু কমাতে এটাই এখন সংসদ সদস্যদের সাংবিধানিক দায়িত্ব। হেলাল আহমেদ বলেন, নাটক-সিনেমায় সিগারেটের দৃশ্য প্রচার ও প্রদর্শন নিষিদ্ধ করতে হবে। ভারতেও ধূমপানের দৃশ্য এখন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। উন্নত প্রায় সব দেশেই ধূমপানের দৃশ্য প্রচার নিষিদ্ধ। যেসব সিনেমা বা নাটকে ধূমপানের দৃশ্য রয়েছে সেসব দৃশ্য বন্ধ করার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়কে সচেতন হতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা এমন একটি কার্যক্রম যার মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের নিজেদের অপকর্মকে আড়াল করে। এধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা মানুষের সহানুভুতি আদায় এবং নীতিনির্ধারকদের উপর তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক নীতি গ্রহণে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। তামাক কোম্পানিগুলোর এধরনের কার্যক্রম তাদের অপকর্মের ক্ষতিপুরণ নয়, বরং এ ধরনের কর্মকান্ডের প্রেক্ষিতে তাদের বিষয়ে একটি ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়। যা তাদের অনৈতিক বানিজ্যিক কার্যক্রমকে প্রসারের জন্য সহায়ক। আইনের মাধ্যমে কোম্পানির বিভ্রান্তিমুলক সামাজিক দায়বদ্ধতামুলক কার্যক্রমগুলো নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।

মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন এর চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানা, তামাক বিরোধী নারী জোট এর প্রতিনিধি সাঈদা আক্তার কুমকুম, উবিনীগ এর গবেষক শাহীনুর বেগম, সিরাক বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক এস এম সৈকত, একলাব এর পরিচালক মো. শামসুল আলম, পিএএসএস এর নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম রিপন, টিএমএসএস এর কর্মকর্তা রেহানা আক্তার।

বক্তারা বলেন, অধিক জনসংখ্যার সীমিত ভুখন্ডের এ দেশে খাদ্যের জমিতে তামাক চাষ খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ, অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। পাশাপাশি তামাক চাষ, দরিদ্রতা ও পুষ্টি ঘাটতি বৃদ্ধির জন্যও দায়ী। তামাক পাতা শুকানোর জন্য প্রতিবছর দেশের বনাঞ্চল ধবংস হয়ে যাচ্ছে, বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর কার্যক্রম দরকার।