প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার
গত ১১ জুন জাতীয় সংসদে মাননীয় অর্থমন্ত্রী ২০২০-২১ অর্থ-বছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন। প্রতি বছরের মত এবারো বাজেটে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ ও করারোপের প্রস্তাব করেছেন মাননীয় মন্ত্রী। এই প্রস্তাবের লক্ষ্য হিসাবে ‘তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমানো এবং রাজস্ব আয় বৃদ্ধি’ বলে তিনি তাঁর বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ ও এর ওপর করারোপ পর্যালোচনা করলে অতি সহজেই অনুমান করা যায়, প্রস্তাবিত এই মূল্য ও কর দিয়ে এই এই লক্ষের একটিও অর্জন সমম্ভব নয়। বরং এই প্রস্তাবের মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী আরো একটি ‘তামাক কোস্পানীর লাভের বাজেট প্রস্তাব’ হাজির করেছেন।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে বিশ্বের যেসব দেশে তামাকজাত দ্রব্য সস্তা, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। প্রতিবছর বাজেটে এসব দ্রব্যের দাম বাড়ানো হলেও পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এই বৃদ্ধি তামাক নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো অবদান রাখছে না বরং সেটা তামাক কোম্পনিকে আরো লাভবান করেছে। জটিল ও স্তর বিশিষ্ট কর কাঠামো এবং ত্রুটিপূর্ণ কর ব্যবস্থার কারণে এটি ঘটছে।
বর্তমান পদ্ধতিতে তামাকের দাম বৃদ্ধি ও করারোপে তামাক কোম্পানির লাভ: বর্তমান পদ্ধতিতে তামাকজাত দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির লাভের অংশ তামাক কোম্পানির ঘরে ওঠে। যেমন, বিগত বাজেটে প্রিমিয়াম স্তরের ১০ শলাকা সিগারেটের দাম ১০৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২৩ টাকা করা হয় এবং সম্পূরক শুল্ক অপরিবর্তিত (৬৫%) রাখা হয়। ফলে বর্ধিত ১৮ টাকার ৬৫% সম্পুরক শুল্ক, ১৫% ভ্যাট ও ১% স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ হিসাবে (মোট ৮৬%) সরকার পেলেও তামাক কোম্পানি এর ১৪% অতিরিক্ত মুনাফা হিসাবে পেয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় একটি বিদেশী তামাক কোম্পানির নিজস্ব তথ্যে দেখা যায় ২০১৮ সালে তাদের উৎপাদন ৩ শতাংশ কমে গেলেও তাদের নিট মুনাফা বেড়েছে ২৮ শতাংশ। যা অন্য পণ্য উৎপাদনকারী কোন কোম্পানির পক্ষে সম্ভবপর নয়। এবারও প্রিমিয়াম স্তরের ১০ শলাকা সিগারেটের দাম ১২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২৮ টাকা নির্ধারণ করে ৬৫% সম্পুরক শুক্ল অপরিবর্তিত রাখা হয়েছ। এবারও তা একইভাবে তামাক কোম্পানীকে লাভবান করবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে তামাকপণ্যের ওপর মূল্যের শতাংশ হারে (ad-valorem) সম্পূরক শুল্ক ধার্য করার ফলে তামাকের মত ক্ষতিকর পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি এভাবে লাভবান হচ্ছে। দেশে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর করারোপের কোন নীতিমালা নেই। সার্বিক সুরাহার জন্য ‘জাতীয় তামাক কর নীতি’ গ্রহণ আবস্যক।
তামাকজাত দ্রব্যের করারোপে জন–বান্ধব প্রস্তাব যেমন হতে পারতো: প্রতি বছর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ ও তামাক-অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ ও করারোপের জন্য একটি সুপারিশ তৈরী করেন। আধুনকি অর্থনৈতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে এই সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়। এই সুপারিশ প্রণয়নে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নসহ সার্বিক জনস্বার্থ সুরক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। এ বছরও একইভাবে তেমন একটি প্রস্তাব প্রস্তুত করা হয়েছে। তামাক বিরোধী সংগঠনগুলো নানাভাবে সরকারের কাছে তা প্রেরণও করেছে।
তামাকজাত দ্রব্যের ওপর করারোপের ‘অ্যড ভ্যালোরেম’ পদ্ধতি তামাক কোস্পানীকে লাভবান করে তাই এই প্রস্তাবে অন্যতম সুপারিশ ছিলো ‘সকল তামাকজাত দ্রব্যের ওপর করারোপের পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে অ্যড ভ্যালোরেম পদ্ধতিতে সম্পুরক শুল্ক আরোপের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করতে হবে হবে’।
বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর করারোপে আরো একটি ত্রুটি হলো সিগারেটের বহু মূল্যস্তরবিশিষ্ট করারোপ ব্যবস্থা। বাংলাদেশে সিগারেটকে চারটি মূল্যস্তরে ভাগকরে করারোপ করা হয়। পদ্ধতিটি একই সাথে জটিল এবং ধূমপায়ীদের নিরুৎসাহিত করতে কার্যকর নয় বরং তা ধূমপান জিইয়ে রাখতে এবং তরুণদের ধূমপান শূরু করতে সহায়ক পরিবেশ তৈরী করে দেয়। কারণ চারটি মূল্য স্তরের কারণে দাম বাড়লেও ধুমপায়ী ব্যবহার না কমিয়ে অপেক্ষাকৃক কমদামের সিগারেট বেছে নিচ্ছে। আবার সহজলভ্য তাই তরুনরা সহজেই ধূমপান শুরু করতে পারছে। তাই এই প্রস্তাবে সিগারেটের মূল্য স্তর চারটি থেকে কমিয়ে দু’টি করতে সুপারিশ করা হয়েছে।
অন্য দিকে তামাকজাত দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির হার যদি নিত্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির হার, মানুষের ক্রয় সামর্থ বৃদ্ধির হার এবং মূদ্রাস্ফীতির হারের চাইতে অধিক না হয় তবে তা তামাক নিয়ন্ত্রণে কোন অবদান রাখতে পারে না। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে সিগারেটের দাম বৃদ্ধির হার নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। বাংলাদেশে বিগত ১০ বছরে চাল ও ডিমের দাম বৃদ্ধির সাথে সিগারেটের দাম বৃদ্ধির তুলনা করে দেখা গেছে প্রয়োজনীয় এই দুটি দ্রব্যের চাইতে সিগারেটের দাম বেড়েছে কম।
এসব বিষয়সমূহ বিবেচনায় রেখে ২০২০-২১ অর্থ বছরের জন্য তামাকজাত দ্রব্যের মূ্ল্য নির্ধারণ ও করারোপে সুপারিশ সুপারিশ করা হয়েছিলো-
- সিগারেটের মূল্যস্তর ৪টি থেকে কমিয়ে ২টি নির্ধারণ করে নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারটের খুচরা মূল্য ৬৫+ টাকা নির্ধারণ করে ৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক এবং উচ্চস্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ন্যূনতম ১২৫+ টাকা নির্ধারণ করে ৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১৯ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।
- ফিল্টার ছাড়া ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৪০ টাকা টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক ও ৬.৮৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক এবং ফিল্টারসহ ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৩২ টাকা টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক ও ৫.৪৮ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।
- জর্দা, প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪০ টাকা টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক ও ৫.৭১ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৩ টাকা টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক ও ৩.৪৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।
উপর্যুক্ত হার ও পরিমাণে করারোপের পাশাপাশি সকল তামাকজাত পণ্যে ১৫% ভ্যাট ও ১% স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আরোপ করা।
বাজেট প্রস্তাবে যা আছে: অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবে উপর্যুক্ত সুপারিশ অনুসারে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়নি এবং সিগারেটের মূল্য স্তর না কমিয়ে আগের মত চারটিই রাখা হয়েছে।
নিম্ন স্তরের সিগারেটের খুচরা মূল্য মাত্র ২ টাকা বাড়িয়ে ৩৯ টাকা নির্ধারণ এবং ৫৫% এর স্থলে ৫৭% সম্পুরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। মধ্যম স্তরের সিগারেটের খুচরা মূল্য গত বছরের মত ৬৩ এবং টাকা এবং ৬৫% সম্পুরক শুল্ক বহাল রাখা হয়েছে। উচ্চ স্তরের সিগারেটের খুচরা মূল্য মাত্র ৪ টাকা বাড়িয়ে ৯৭ টাকা এবং প্রিমিয়ার স্তরের মূল্য ৫ টাকা বাড়িয়ে ১২৮ টাকা নির্ধারণ করে উভয় ক্ষেত্রেই ৬৫% সম্পুরক শুল্ক বহাল রাখা হয়েছে।
ফিল্টার ছাড়া ২৫ শলাকা বিড়ির মূল্য ১৪টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা, ১২ শলাকার মূল্য ৬.৭২ থেকে ৯ টাকা এবং ৪.৪৮ টাকা থেকে ৬ টাকা নির্ধারণ করে ৩০% সম্পূরক শুল্ক বহাল রাখা হয়েছে। ফিল্টারসহ ২০ শলাকা বিড়ির মূল্য ১৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৯ টাকা এবং ১০ শলাকার মূল্য ৮.৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা নির্ধারণ করে ৪০% সম্পূরক শুল্ক বহাল রাখা হয়েছে। জর্দা প্রতি ১০ গ্রামের খুচরা মূল্য ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা এবং গুল প্রতি ১০ গ্রামের খুচরা মূল্য ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা নির্ধারণ করে উভয় ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক ৫০% থেকে বাড়িয়ে ৫৫% নির্ধারণ করা হয়েছে।
এই প্রস্তাব লক্ষ্য পূরণে কতটা অবদান রাখবে: মাননীয় অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট প্রস্তাবে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর করারোপের লক্ষ্য হিসাবে ‘তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমানো এবং রাজত্ব আয় বৃদ্ধি’ বলে উল্লেখ করেছেন যা আগেই । কিন্তু এই মূল্য ও কর দিয়ে দুটি লক্ষ্যের একটিও অর্জন সম্ভব নয় বরং এটি উল্টো ফল বয়ে আনবে। যেমন, নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের দাম মাত্র ২ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, এতে প্রতি শলাকায় দাম বাড়বে মাত্র ২০ পয়সা বা ৫.৪ শতাংশ অথচ একইসময়ে মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এর চেয়ে অনেক বেশি (১১.৬ শতাংশ)। সিগারেট ধুমপায়ীদের ৭২ শতাংশই নিম্নস্তরের সিগারেটের ভোক্তা। নিম্ন স্তরে এই সামান্য দাম বৃদ্ধি এবং মধ্যম স্তরের দাম অপরির্তিত রাখায় তাদের ধূমপানের অভ্যাস আরো বাড়েয়ে দেবে এবং আয় বৃদ্ধির তুলনায় পণ্যটি সস্তা হয়ে যাওয়ায় তরুণরা ধুমপানে উৎসাহিত হবে।
উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরে যথাক্রমে মাত্র ৪ টাকা ও ৫ টাকা দাম বৃদ্ধি একই ফল আনবে বরং এখানে কর হার বৃদ্ধি না কারায় তামাক কোম্পানীর লাভ বেড়ে যাবে এবং সুনির্দিষ্ট কর আরোপ না করায় সরকার অতিরিক্ত রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে।
প্রতি শলাকা বিড়ির দাম বেড়েছে মাত্র ১৬ পয়সা। এই বৃদ্ধি তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমাতে বা রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে কতটা অবদান রাখবে তা সহজেই অনুমেয়। বরং এখানেও কোম্পানীর লাভ ২৫ শলাকার প্রতি প্যাকেটে ২ টাকা ১৬ পয়সা বাড়ছে । জর্দা ও গুলের মূল্য বৃদ্ধি সন্তোষজনক হলেও সুনির্দিষ্ট কর আরোপ না করায় এখানেও উৎপাদনকারী কোস্পানীর লাভ বাড়ছে প্রতি ১০ গ্রাম জর্দায় ১ টাকা ৪০ পয়সা এবং গুলে ৭০ পয়সা।
সার্বিক পর্যলোচনায় দেখা যায় ‘তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমানো এবং রাজত্ব আয় বৃদ্ধির যে লক্ষ নিয়ে তামাক ও তামাকজাত দ্রবের ওপর মূল্য ও কর প্রস্তাব করা হয়েছে তা পূরণ হবে না। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে না, সাধারণ মানুষের ধূমপান ছাড়তে বা কমাতে কোন ভূমিকা রাখবে না এবং ধূমপান শুরু করতে পারে এমন তরুণ প্রজন্মকে ধূমপানে নিরুৎসাহিত করা যাবেনা। সর্বোপরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির ওপর এটি মারাত্বক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এটি তামাক কোম্পানীকে নানাভাবে লাভবান করবে যা তাদেরকে ব্যবসা প্রসারে উৎসাহিত করবে। এই বাজেট প্রস্তাব করার মাধ্যমে মাননীয় অর্থমন্ত্রী আরো একটি ‘তামাক কোম্পানীর লাভের বাজেট’ ঘোষণা করলেন।
জীবন বাঁচাতে ও রাজস্ব আয় বাড়াতে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর সুনির্দিষ্ট করারোপ: বিশেষজ্ঞগণ বলেন, প্রস্তাবিত পরিমাণে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ ও করারোপ, ‘সুনির্দিষ্ট কর’ আরোপ এবং সিগারেটের মূল্যস্তর চারটির পরিবর্তে দুইটি নির্ধারণ করা হলে ২০ লক্ষ ধুমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দেবে। প্রস্তাবিত হার ও পদ্ধতিতে করারোপের ফলে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে ৬ লক্ষ ধূমপায়ীর জীবন রক্ষা হবে। একইসঙ্গে রাজস্ব আয় প্রায় ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা থেকে ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। প্রথম বছরেই যার হার হবে বিড়ি ও সিগারেট থেকে প্রাপ্ত বর্তমান কর রাজস্বের চেয়ে অন্তত ১৪% বেশি।
করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারীর কারণে দেশ এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। এই ক্ষতি পোষানোর জন্য সরকারের প্রয়োজন অতিরিক্ত রাজস্ব আয়। তামাকজাত ত্রব্যের ওপর সুনির্দিষ্ট করারোপের মাধ্যমে ১১ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করা সম্ভব। এই অতিরিক্ত আয় করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতি পোষাতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
জনস্বাস্থ্য গোল্লায় যাক: প্রতি বছর তামাকজাত দ্রব্যের ওপর করারোপে সরকারের সিদ্ধান্ত দেখে মনে হয় তারা “জনস্বাস্থ্য গোল্লায় যাক, তামাক কোম্পানী বেঁচে থাক” নীতিতে বিশ্বাসী। তামাক ব্যবহার বিভিন্ন রোগ ও অকালমৃত্যুর ঝুঁকি তৈরির একটি প্রধান কারণ তা আমরা সবাই জানি।
গবেষণায় দেখাযায় বাংলাদেশে প্রায় ৩৫% প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। দেশে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ তামাক ব্যবহার। ২০১৮ সালে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বাংলাদেশে প্রায় ১,২৬,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। ২০১৭-১৮ সালে তামাক ব্যবহারজনিত রোগের কারণে উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং চিকিৎসাজনিত ব্যায় মিলিয়ে মোট অর্থনৈতিক ব্যায়ের পরিমাণ ছিল আনুমানিক ৩০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, যেখানে একই সময়ে তামাক খাত থেকে সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট বাবদ প্রাপ্ত রাজস্বের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা।
বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক তামাক ব্যবহারকারী ও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার ৪ কোটি ১০ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নজিরবিহীন স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়বে। এমন সব সতর্কতা উপেক্ষা করে সরকার তামাক কোম্পানীকে বাঁচিয়ে রাখার নীতি গ্রহণ করেছে। অন্তত এই বাজেট প্রস্তাব তাই বলে।
আমরা কোনটা বিশ্বাস করবো? বর্তমান সরকার প্রধান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এবং সে লক্ষ অর্জনে একটি শক্তিশালী তামাক শুল্ক-নীতি গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এটি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার পদক্ষেপ হিসাবে জাতির কাছে দেয়া তাঁর অঙ্গীকারও বটে। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল কেটি রোডম্যাপ প্রণয়নে কাজ করছে।
২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে তামাকের ব্যবহার প্রতি বছর গড়ে ১.৫% হারে কমাতে হবে। এই সম্ভাবনা বাড়বে যদি আরো আগেই তামাক ব্যবহারের প্রবণতা ব্যাপকহারে কমিয়ে আনা যায়। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ২০২১ সালের মধ্যে বর্তমান তামাক ব্যবহারের প্রবণতা ২৮.৪% কমানোর লক্ষ্য স্থির করতে হবে। এই লক্ষ্য বিবেচনা করেই এবারের তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য ও করারোপর সুপারিশ করা হয়েছিলো।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর করারোপে সরকারের সিদ্ধান্ত বিবেচনা করলে আমরা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি। প্রশ্ন জাগে, আসলেই কী সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চায় নাকি এটা কথার কথা? আবার, আমরা এটাও বিশ্বাস করতে চাই না যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমন ‘কথার কথা’ বলতে পারেন! আমার বিশ্বাস প্রকৃত তত্ত্ব ও চিত্র তাঁর কাছে পৌছাচ্ছে না। তাই হয়তো বার বার এমন জনস্বার্থ পরিপন্থী সিদ্ধান্ত গৃহীত হচ্ছে। কেউ কী আছেন দয়া করে তাঁর কাছে প্রকৃত তত্ত্ব, তথ্য ও উপাত্য উপস্থাপন করে প্রকৃত অবস্থাটা তাঁর নজরে আনবেন। যেকোন শুভ সিদ্ধান্তের জন্য জাতির একমাত্র ভরসা তো তিনিই।
হামিদুল হিল্লোল, প্রকল্প ব্যবস্থাপক, সচিবালয়, বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি)