প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার
তামাক নিয়ন্ত্রণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার অনুযায়ী কাজ করছে না কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যে কারণে তামাক চাষ বাড়ছে- জোট’র সাথে একান্ত স্বাক্ষাৎকারে পরিবেশবিদ আবু নাসের খান
আমি মূলত পরিবেশ সংগঠক। পরিবেশের ক্ষতি করে এমন সব বিষয়ই আমার কাজের আওতায় পড়ে। তামাক চাষ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান করলে সেখানকার বাতাস দূষিত হয়। বাতাসও পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সুতরাং, তামাক নিয়ন্ত্রণও আমার কাজের আওতায় পড়ে। ৯০ দশকের দেশে পরিবেশ রক্ষায় সামাজিক আন্দোলনে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করেছি। ৯৭ সালে পরিবেশ রক্ষার শপথ (পরশ) প্রতিষ্ঠা করি, ২০০০ সালে এর নাম হয় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)। অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত বাপা’র প্রথম সভাপতি ছিলেন ও প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে আমি ছিলাম সাধারণ সম্পাদক। আমরা বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের কর্মসূচিগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি। তখন তামাক নিয়ন্ত্রণে অল্প কয়েকটা সংগঠন কাজ করত। ২০০৪ সালে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) প্রতিষ্ঠা করি, পবাও পরিবেশের অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
তামাক বিরোধী জোটের আন্দোলনের ফলে দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয়েছে। জোট শুধু আইনের দাবি করেনি, আইন প্রণয়নে সরকারকে সহায়তাও করেছে। আইন বাস্তবায়নেও সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। জোটের সুপারিশের প্রেক্ষিতে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল এবং সারাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে জাতীয়, জেলা ও উপজেলা টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার।
তামাক চাষ প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের ক্ষতি করে বেশি। তামাক চাষের কারণে মাটি-পানি-বায়ু দূষিত হয়। তামাক পাতা প্রক্রিয়াজাত করার কাজে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন হয়। তামাক চাষের কারণে বাংলাদেশের কৃষি জমি উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে, কৃষি জমি কমছে। তামাক চাষে যে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে এগুলোর কারণে কৃষি ব্যবস্থা, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। তামাক চাষের জন্য হাজার হাজার গাছ কাটার পরও তামাক কোম্পানিকে বৃক্ষরোপনের জন্য জাতীয় পুরস্কার দেয়া হতো। তামাক কোম্পানি তাদের অপকর্ম ধামাচাপা দিতে তাড়াতাড়ি বড় হয়- ইপিল ইপিল, ইউক্যালিপটাসসহ পরিবেশবিধ্বংসী বিদেশী গাছ লাগাত। আমাদের প্রতিবাদে তামাক কোম্পানিকে বৃক্ষরোপনের জন্য পুরস্কার দেয়ার প্রবণতা বন্ধ হয়েছে।
২০০৮ সালের পর তামাক নিয়ন্ত্রণে দেশি-বিদেশি অর্থায়ন শুরু হওয়ায় অনেক নতুন সংগঠন যুক্ত হয়েছে, হচ্ছে। সামাজিক আন্দোলন বেগবান হওয়ায় সরকারের দিক থেকেও অগ্রগতি হয়েছে। তামাকের মোড়কে ছবিসহ সতর্কবার্তা এসেছে। পাবলিক প্লেস/পরিবহন ধূমপানমুক্ত, তামাকের সবরকম বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ ও ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাছে তামাক বিক্রি বা তাদের দ্বারা বিক্রয় নিষিদ্ধ হয়েছে। আইন বাস্তবায়নে দুর্বলতার কারণে এসব পরিবর্তনের সুফল সমভাবে পাওয়া যাচ্ছে না, এটাও সত্য।
আইন বাস্তবায়নের বিষয়টি মনিটর করার জন্য জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলকে শক্তিশালী করতে হবে এবং জাতীয়, জেলা ও উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটিগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় নিয়মিতভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা দরকার। ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ করতে প্রধানমন্ত্রী যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সেজন্য আইন লঙ্ঘণের দায়ে অভিযুক্ত তামাক কোম্পানিগুলোকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান নিশ্চিত করতে বিড়ি-জর্দা-গুল কোম্পানিগুলোকে নজরদারির মধ্যে আনা দরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল যৌথভাবে এ কাজ করতে পারে। মুদ্রাস্ফিতী ও গড় আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তামাকের উপর কর বাড়ানোর ক্ষেত্রেও এনবিআরকে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, তামাক থেকে রাজস্ব আয় মুখ্য নয়, তামাকজনিত মৃত্যু, পঙ্গুত্ব কমিয়ে আনা ও তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে আনার মাধ্যমে উন্নয়ন টেকসই করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তামাক নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ব্যর্থ হয়েছে। যে কারণে গত ১০ বছরে তামাক চাষ অনেক বেড়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, কৃষি বিভাগের লোকজন সে অঙ্গীকার ধারণ ও তদানুযায়ী কাজ করেনি। নইলে খাদ্যের জমিতে তামাকের মত নেশাসৃষ্টিকারী, প্রাণঘাতী বিষাক্ত পণ্যের চাষ হতো না। তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের আগাম ঋণ, তামাকের বীজ, সার ও কীটনাশক সরবরাহ করে আসছে। এগুলো মনিটর করে বন্ধ করা যায়নি। সরকার তামাক চাষে কোন ঋণ দেয় না, সার দেয়া না। কিন্তু তামাক চাষে ব্যবহৃত লক্ষ লক্ষ মন সার কোথা থেকে আসছে, তার কোন মনিটরিং নেই। তামাক নিয়ন্ত্রণ যত সংগঠন কাজ করে, এদের অনেকেই তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে সোচ্চার নয়, এটাও একটা কারণ।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রাকবাজেট নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। সেখানে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) চেয়ারম্যান হিসাবে আমি অংশ নিয়েছিলাম। আমি যেহেতু তামাক বিরোধী জোটেরও উপদেষ্টা, তাই আমার বক্তব্যে পরিবেশের বিষয়গুলোর পাশাপাশি তামাকের কর বৃদ্ধির সুপারিশ ছিল। অর্থ মন্ত্রী আমার সুপারিশগুলো গুরুত্বসহ নিয়েছিলেন এবং আমার সুপারিশের প্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন, ‘বিড়ি শিল্প আর থাকতে পারে না’। সেটা আমাদের একটা বড় ধরনের সাহস যোগায়।
অর্থমন্ত্রী হয়ত আমার কথা এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় তিন যুগেরও বেশি। ৮০ ও ৯০ দশকে আমরা অনেক বছর একসঙ্গে কাজ করেছি। তাঁর সঙ্গে বিভিন্নরকম কাজে যুক্ত ছিলাম। তিনিও আমার অনেক কাজে যুক্ত ছিলেন। যেমন আমি যখন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) প্রতিষ্ঠা করি, তখন তাঁকে এর সভাপতির দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ জানালে তিনি সানন্দে রাজি হয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর আমরা পরিবেশ নিয়ে কাজ করেছিলাম। তিনি যেহেতু জানেন, আমি যা বলি, তা বিশ্বাস থেকে বলি এবং এ বিষয়ে আমি কাজও করি। তাই তিনি আমার সুপারিশকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
তামাক নিয়ন্ত্রণে এটা উপযুক্ত সময়, একটা ভালো সুযোগ এসেছে, একটা ওয়েব এসেছে, মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। এখনই যদি সরকার তামাকমুক্ত করার পরিকল্পনা অর্জনে একটা রোডম্যাপ তৈরী করে তাহলে ২০৪০ সালের মধ্যেই দেশকে তামাকমুক্ত করা সম্ভব। এ পরিকল্পনায় আইনগত বিষয় (বিদ্যমান আইন বাস্তবায়ন ও সংশোধন) যেমন দরকার, তেমনি কারিগরি সহায়তাও দরকার। যেমন, যে দরিদ্র কৃষক তামাক চাষ করবে না সরকার কিভাবে তাকে সহায়তা করবে? এজন্য একটা নীতিমালা থাকা দরকার।
আবু নাসের খান
পরিবেশবিদ ও চেয়ারম্যান, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এবং উপদেষ্টা, বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট