প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার
তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আলোচনায় আমাদের দেশে নারী ও শিশুদের উপর তামাকের ক্ষতির বিষয়টি সবসময় অবহেলিত রয়ে যায়। আমাদের দেশের নারীরা তামাকজাত পণ্য যেমন- জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা ইত্যাদি ব্যবহার করে আসলেও ইদানিং সিগারেট কোম্পানির প্রচারণার কারণে নারীদের মাঝে সিগারেটের ব্যবহারও বাড়ছে। ITC (The International Tobacco Control Policy Evolution Project) 2010২০১০ এর তথ্য অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে নারী তামাক সেবী বেড়েছে ২৪.৪% থেকে ৩২.০% এবং নারী ধূমপায়ীর সংখ্যা বেড়েছে ১.৩ %। Global Adult Tobacco Survey -2009 এর তথ্য অনুসারে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্ক^ তামাক ব্যবহারকারী প্রায় ৪ কোটির বেশি। এর মধ্যে তামাক ব্যবহারকারী নারীর সংখ্যা ২৯% এবং সিগারেটের মাধ্যমে ধূমপায়ী নারীর সংখ্যা ১.৫% এবং বিড়ির মাধ্যমে ধূমপায়ীর সংখ্যা ১.১%। এছাড়া কর্মস্থল, পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ১ কোটি নারী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ সামাজিক রীতিনীতির অংশ হিসেবে জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা ব্যবহার হয়ে আসছে। নারীদের মাঝে ধূমপায়ীর সংখ্যা কম হলেও অনেক নারী জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা ব্যবহারে অভ্যস্ত। কিন্তু ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ এ তামাকজাত দ্রব্যের সংজ্ঞায় জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা ইত্যাদি অর্ন্তভুক্ত করা হয়নি। অপরদিকে নারীদের মাঝে ধূমপায়ীর হার কম হলেও পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে পুরুষদের ধূমপানের কারণে নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি বর্তমানের তামাক কোম্পানিগুলোর প্রচারণার কারণে নারীদের মাঝেও সিগারেটের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কৌশলের অংশ হিসেবে তারা চলচ্চিত্র এবং নাটকে ধূমপানের দৃশ্য প্রর্দশনের মাধ্যমে নারীদের উৎসাহী করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। সামাজিক রীতিনীতিতে তামাকের ব্যবহার এবং সিগারেট কোম্পানিগুলোর প্রচারণার ফলে আমাদের সমাজে তামাকের ব্যবহার বৃদ্ধি জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে নারীদের রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
নারীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের ভয়াবহতা ব্যাপক। তামাক ব্যবহারের ফলে সরাসরি স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব পড়ে। যেহেতু তামাক এবং ধূমপানের ফলে মানুষের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায় তাই নানারকম রোগ ও শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। যার মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সার, মুখ ও মুখগহব্বরের নানারকম ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। জরায়ু ক্যান্সারসহ অন্যান্য ধরনের ক্যান্সার, হাঁপানি, যক্ষা, কাশি, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এর ঝুঁকিও অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাবে নারীদের গর্ভধারন ক্ষমতা দ্রুত লোপ পায়, ঋতুস্রাবে সমস্যা দেখা দেয়। তামাক ও ধূমপানের প্রভাবে মহিলাদের কম ওজনের বা মৃত শিশু বা অকাল প্রসবের সম্ভাবনা এবং কম স্মৃতিসম্পন্ন সন্তান প্রসব করার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় এবং রেসপিরেটরি সমস্যা দেখা দেয়। শুধু সরাসরি তামাক সেবন কিংবা ধূমপানই এসব রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে তাই নয়, পরোক্ষ ধূমপানের ফলেও নারীদের এসব রোগের সম্ভাবনা থেকে যায়।
বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া ৪০০০ এর বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, তাই এ ধোঁয়া মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব রাসায়নিক পদার্থের ফলে ক্যান্সারসহ নানারকম ভয়াবহ রোগের জন্ম। ধূমপায়ীরা ধূমপানের সময় খুব সামান্য পরিমাণ ধোঁয়া গ্রহণ করে এবং বেশিরভাগ ধোঁয়া বাইরে নিক্ষেপ করে। তাই ধূমপায়ীরা আশেপাশে অবস্থানকারী নারী-শিশুসহ অধূমপায়ীরাও পরোক্ষ ধূমপানের ফলে ধূমপানজনিত ক্ষতির ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। বাসায় বাবা-ভাই-স্বামী’র ধূমপান, কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর ধূমপান, যানবাহনে ও পাবলিক প্লেসে অন্যদের ধূমপানের ফলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়ায় এ্যাজমা, স্তন এবং ফুসফুস ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যে সব নারী প্রতিদিন ১ ঘন্টা ধূমপায়ীর সাথে থাকে তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ। ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন হওয়ার পর পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ হওয়ায় মানুষের মধ্যে সচেতনতা এসেছে, পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের হার কমেছে। তবু এখনও বিভিন্ন স্থানে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে নারীদের ধূমপানজনিত ক্ষতি থেকে মুক্ত করা যায়নি।
তামাক ব্যবহারের ভয়াবহতা শুধূমাত্র বাংলাদেশী নারীরা নয় সারা বিশ্ব ঝুঁকির মধ্যে আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে প্রায় ১ বিলিয়ন নারী ধূমপান করে যা বিশ্বের মোট ধূমপায়ীর ২০%। এই সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শুধু তাই নয় বিশ্বে তরুনীদের মধ্যেও তামাক ব্যবহার ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৫১টি দেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় সে সমস্ত দেশে প্রায় ৭% কিশোরী ধূমপান করে যেখানে কিশোর ধূমপায়ীর সংখ্যা ১২%। কিছু কিছু দেশে কিশোর কিশোরী ধূমপায়ীর হার প্রায় সমান। তামাকের ভয়াবহতা রোধে নারীদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও এর উন্নয়ন বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের সুস্বাস্থ্য ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ন।
আমাদের দেশের একটা বড় অংশ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে এবং তাদের প্রাত্যহিক আয় অনেক কম। তাদের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক আয়ের একটা বড় অংশ তামাকের পিছনে ব্যয় হওয়ায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। গবেষনায় দেখা যায় তামাক ব্যবহারকারীরা তাদের মাসিক গৃহস্থালী খরচের ৪.৫% তামাকের পেছনে ব্যয় করেন। পুরুষদের উপার্জিত অর্থের বড় অংশ তামাকের পিছনে ব্যয় করার ফলে প্রভাব পড়ে নারী, শিশুদের খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্যের উপর এবং ঘাটতি সৃষ্টি হয় মৌলিক চাহিদার উপর। ২০০১ সালের গবেষণালব্ধ রিপোর্ট ‘দরিদ্্রতা এবং তামাক’ এ দেখা যায়, অপুষ্টির কারণে প্রতিদিন যে ৭০০ শিশু মারা যাচ্ছে তার ৩৫০ জনকে বাঁচানো সম্ভব হবে যদি প্রতিদিন মানুষ তামাকের পেছনে যে অর্থ ব্যয় করছে তার ৬৯ শতাংশও যদি খাবারের জন্য ব্যয় করে।
বিড়ি কারখানাগুলোতে পুরুষের পাশাপাশি স্বল্প মজুরীতে বিপুলসংখ্যক নারী ও শিশু শ্রমিকও কাজ করে। অকল্পনীয় নিম্ন মজুরী বিড়ি শ্রমিকের জীবনকে করে তোলে অসহনীয়। অপরদিকে তামাক চাষের উৎপাদন খরচ কমাতে চাষীরা তাদের স্ত্রীকে এবং অন্যান্যদের তামাক চাষে সম্পৃক্ত করে । তামাক চাষ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত করনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারীরা।
নারীদের মধ্যে তামাকের ব্যবহার একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা যা অবশ্যই মোকাবেলা করতে হবে। তামাক কোম্পানিগুলো সারা বিশ্বে নারীদেরকে লক্ষ্যবস্তু করছে, নারীদের স্বাস্থ্যকে ক্রমবর্ধমানভাবে ঝুঁকির সম্মুখীন করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী এই শতাব্দিতে ১ বিলিয়ন লোক তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে মারা যাবে। নারীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের মাত্রা কমিয়ে আনার মাধ্যমে অনেক জীবন রক্ষা করা যেতে পারে। নারী ও শিশুদের উপর তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব রোধে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতাসহ সকল ধরনের তামাক জাতীয় দ্রব্যকে আইনে অন্তূর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের হাত হতে রক্ষায়, কর্মস্থল, পাবলিক প্লেস ও পরিবহনসহ সকল জনসমাগমস্থল ১০০% ধূমপানমুক্ত করা জরুরি। সরকারী প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কর্মস্থল, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এবং শিশু ও মহিলা যাতায়াত করে এ ধরনের সকল স্থান ধূমপানমুক্ত করতে তড়িৎ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
লেখক: সৈয়দা অনন্যা রহমান, ন্যাশনাল এডভোকেসী অফিসার, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট