তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়নে তামাকে উচ্চহারে করারোপের আবশ্যকতা

জনস্বাস্থ্যের উপর তামাকের ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সমগ্র বিশ্ব অবহিত এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাস করার জন্য বিশ্ববাসী সচেষ্ট। এতদসত্ত্বেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মোতাবেক সমগ্র বিশ্বে ধূমপান ও তামাকজাত পণ্যের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বছরে ৫৪ লক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবে ৬ লক্ষ ৬০ লক্ষ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে। এক্ষেত্রে তুলনামূলক বিচারে বাংলদেশের অবস্থা খুবই নাজুক। বাংলাদেশে ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য সেবনের প্রভাব কতটা ভয়াবহ দুইটি পরিসংখ্যান থেকেই তা সুষ্পষ্ট। এদেশে ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য সেবনের কারণে প্রতিবছর ১ লক্ষ ৬২ হাজারেরও বেশী মানুষ মারা যাবার পাশাপাশি ১২ লক্ষ মানুষ ক্যান্সার, যক্ষা, ডায়াবেটিস, হাঁপানি ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। দুর্ভাগ্যজনক সত্য এই যে, বাংলাদেশে তামাক অর্থকরি ফসল হিসেবে বিবেচিত। এনবিআর এর হিসাব মোতাবেক সিগারেট ও অন্যান্য তামাক জাতীয় পণ্য হতে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে সরকারের বার্ষিক রাজস্ব আয় হয়েছে ২২,৮৬৬.৯১ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলদেশ ক্যন্সার সোসাইটির যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন হতে জানা যায় তামাকজনিত রোগ ও অকাল মৃত্যুর কারণে একই সময়ে এদেশে ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, যা ছিলো সংশ্লিষ্টি অর্থবছরের জিডিপি’র ১.৪ শতাংশ।

বিভিন্ন বেসরকারী, স্বেচ্ছাসেবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান এবং দায়িত্বশীল নাগরিকবৃন্দ জনস্বাস্থ্যের উপর তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাস করার অভিপ্রায়ে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। সরকারি পর্যায়েও তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে এর ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাস করার জন্য গৃহীত হয়েছে নানাবিধ উদ্যোগ। বাংলাদেশ সরকার ২০০৩ সনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত তামাক নিয়ন্ত্রণে আর্ন্তজাতিক চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) স্বাক্ষর করার পাশাপাশি ২০০৫ সনে “ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন” পাস করেছে। পরবর্তীতে ২০১৩ সনে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনয়নসহ ২০১৫ সনে বিধিমালা জারী করেছে। এসডিজি’র স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ক ৩নং অভিলক্ষ্য অনুযায়ী এফসিটিসি বাস্তবায়ন ও অসংক্রামক রোগ এক-তৃতীয়াংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়কে অন্তর্ভূক্ত করেছে। তামাকের ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব এবং তামাক নিয়ন্ত্রণে অনুধাবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৩১ জানুযারী ২০১৬ তারিখে এসডিজি বিষয়ক দক্ষিণ এশিয়ান স্পিকারদের শীর্ষ সম্মেলনের সমাপণী অনুষ্ঠানে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাক ব্যবহার সম্পূর্ণ নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছেন। এসব কারণে তামাক নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা এদেশের উপর প্রযোজ্য। এফসিটিসি -এর স্বাক্ষরকারী হিসেবে বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্যের মোড়কে সতর্কীকরণ বার্তা লেখার নিয়ম বাধ্য বাধকতামূলক করা হয়েছে এবং তামাকের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ এর মূল্য বৃদ্ধির মাধমে ব্যবহার হ্রাস করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে।

এতদসেত্ত্বেও বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার বিশেষ করে ধোয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের হার আশানুরূপভাবে কমেনি। গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে, ২০১৭ প্রতিবেদনে ১৫ বছরের ওপরে বয়সধারীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ অর্থ্যাৎ ৩৫.৩% মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্যে পুরুষ ৪৬% আর নারী ২৫%। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী ২০০৪ সনে বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারকারী ছিলো ৩৬% , যা গ্লোবাল এডাল্ট সার্ভে প্রতিবেদন মোতাবেক ২০০৯ সনে বেড়ে দাড়িয়েছে ৪৩.৩% (২০০৯-২০১৭)। এ পরিসংখ্যানটি খুবই হতাশাব্যঞ্জক হলেও তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণের ফলে গত ৮ বছরে বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার ৮ শতাংশ কমেছে মর্মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখিত তথ্যাবলী থেকে একটি বিষয় সুষ্পষ্ট যে, তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আমাদের গৃহীত কার্যক্রম খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। ফলে আশংকা করার কারণ রয়েছে যে, তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে যে শম্ভূক গতি বর্তমানে বিদ্যমান- তা অব্যাহত থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাক ব্যবহার সম্পূর্ণ নিমূল করাতো দূরের কথা এসডিজি’র লক্ষমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সনের মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর হার ২৫% -এ নামিয়ে আনা সম্ভব নাও হতে পারে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তামাক ব্যবহার সম্পূর্ণ নির্মূল করার যে ঘোষণা দিয়েছেন তা বাস্তাবায়নে প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন করা নীতি নির্ধারকগণের নৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করতে হলে নীতি নির্ধারকগণকে নীতি প্রণয়নে অনেক বেশী কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে। একইসাথে গৃহীত নীতি যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সে বিষয়েও কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। সুশাসনের ঘাটতি বা অন্যবিধ কারণে নীতি বাস্তবায়িত হবার সম্ভাবনা কম-এমনতর অযুহাত দেখিয়ে নীতি প্রণয়নে সমঝোতার আশ্রয় নেয়ার সুযোগ নেই।

অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কোন পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়লে তার ব্যবহারও অস্বাভাবিকভাবে কমে যাবে। তাহলে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন ও বিপণনের অনেক বেশী করারোপ করতে আমাদের অসুবিধা কোথায়? অনেকে হয়তো বলবেন যে, এতে করে তামাক শিল্পে ধ্বস নামবে, সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হতে বঞ্চিত হবে, তামাক শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকেরা বেকার হয়ে পড়বে। অনেক বেশী করারোপ তামাক ও তামাকজাত পণ্যের অবৈধ উৎপাদন ও বানিজ্য (illicit production and trading) কে উৎসাহিত করবে বিধায় এর ফলে তামাক ও তামাকজাত পন্যের ব্যবহার না কমে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাবে।

আমি সবিনয়ে উল্লেখিত প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে চাই। ধরা যাক, তামাক ও তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন ও বিপণনে বিদ্যমান করের হার ৫ গুণ বা ৫০০% বাড়ানো হলো। ফলাফলটা কি দাঁড়াবে? তামাকের মাত্রাতিরিক্ত দাম বাড়ায় তা হয়তো ধনিক শ্রেণির আচরণে খুব একটা প্রভাব ফেলবেনা, এর ফলে মধ্যবিত্তরা কম মূল্যের তামাকজাত পণ্যের দিকে ঝুঁকবে, নিম্ন বিত্তদের সিংহভাগ তামাকের ব্যবহার ছাড়তে বাধ্য হবে। তামাকের ব্যবহার হয়তো ৫০% কমে যাবে, কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে এতে করে সরকারের রাজস্ব প্রাপ্তি হ্রাস হবার সম্ভাবনা খুব কম থাকবে। তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া যাক, সরকারের রাজস্ব প্রাপ্তি ৩০-৩৫% হ্রাস পাবে, মাত্রাতিরিক্ত করারোপ পূর্ববর্তী বাৎসরিক রাজস্ব ২২,৮৬৬.৯১ কোটি হতে কমে ১৫-১৬ হাজার কোটিতে দাঁড়াবে। অর্থ্যাৎ এ কারণে বিগত বছরে ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকার যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তা কমে হয়তো ৬ হাজার কোটিতে দাঁড়াবে। সাকুল্যে সরকারের নিট লাভ হবে প্রায় সতের হাজার কোটি টাকা। তামাক ও তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন ও বিপণনে মাত্রাতিরিক্ত করারোপ করায় পৃথিবীর অনেক দেশেই তামাকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে বিধায় সে উদাহরণকে আমাদের নীতি নির্ধারকগণ যুক্তি হিসেবে সহজেই গ্রহণ করতে পারেন।

অবশ্যই স্বাস্থের উপর তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব অত্যান্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে সকল বস্তুর ব্যবহার বাদ দিলে অকাল মৃত্যু ঝুঁকি হ্রাস করা যায় এর মধ্যে তামাক শীর্ষে। কেননা, বিশ্বে যত লোক তামাক ব্যবহার করে তার প্রায় অর্ধেক তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবে মৃত্যুবরণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্টের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্টোল এন্ড প্রিভেনশন (ঈউঈ) সেন্টার তামাক ব্যবহারকে বিশ্বব্যাপী অকাল মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছে। চিকিৎসকগণ নিশ্চিত করেছেন যে, তামাক হৃৎপিন্ড, লিভার ও ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ধূমপানের ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্টোক, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, এমফাইসিমা ও ক্রনিক ব্রংকাইটিস, ফুসফুসের ক্যান্সার, প্যানক্রিযাসের ক্যান্সার, ল্যরিংস ও মুখ-গহ্বরের ক্যান্সার এসবের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত তামাকজাত দ্রব্যের ও পরোক্ষ ধূমপানের ধোঁয়াও সকল বয়সী ব্যক্তির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। গর্ভবতী নারীদের উপর তামাকের ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। গবেষনায় প্রমাণিত যে, দীর্ঘকাল ধূমপানের ফলে সার্বিক গড়ায়ু অধুমপায়ীদের তুলনায় ১০ বছর থেকে ১৭.৯ বছর পর্যন্ত হ্রাস পায়। এজন্য বিশেষজ্ঞগণ তামাককে নির্ভরশীলতার দিক থেকে ৩য়, শারীরিক ক্ষতির দিক থেকে ১৪ তম ও সামাজিক ক্ষতির দিক থেকে ১২ তম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার অস্বাভাবিকভাবে কমে গেলে তামাক শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকেরা বেকার হয়ে পড়বে তা ভাববার সংগত কারণ নেই। কেননা, অধিকাংশ তামাক শিল্প গড়ে উঠেছে উত্তরবঙ্গসহ কতিপয় ভৌগলিক পকেটে। তামাক শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকেরা সহজেই কৃষি শ্রমিকে রুপান্তরিত হতে পারবেন। তামাক ও তামাকজাত পণ্যের অবৈধ উৎপাদন ও বানিজ্য (illicit production and trading) বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনার বিষয়টি সুশাসনের সাথে সম্পর্কিত। আমরা সুশাসনের কাক্সিক্ষত মানে উপনীত হতে পারলে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের অবৈধ বানিজ্য ও বিপণন আবশ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে সেকথা সহজেই অনুমেয়। ইতোমধ্যে দুর্নীতি বিষয়ে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষনা করেছে। তাই সুশাসনের কাক্সিক্ষত মানে উপনীত হওয়ার অভিপ্রায়কে পাশ কাটিয়ে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের অবৈধ উৎপাদন ও বানিজ্য এর দোহাই দিয়ে তামাকজাত দ্রব্যের উপর বর্ধিত করারোপ এর বিরোধিতা করা কোনমতেই সংগত হতে পারে না। ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তামাক ব্যবহার সম্পূর্ন নির্মূল করার প্রসংগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করতে হলে এ মুহূর্তে আমাদেরকে তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রনে অনেক কঠোর সিদ্বান্ত গ্রহন করতে হবে। এক্ষেত্রে কালবিলম্বের বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। এমুহূর্তে শতভাগ উদ্যোগী ও শতভাগ কঠোর হওয়া ছাড়া আমাদেরকে আর কোন বিকল্প নেই। আশা করবো স্বাস্থ্য সচেতন সকল সহকর্মী এবং বিজ্ঞ অংশগ্রহণকারীগণ জাতীয় ও জনস্বার্থে এই প্রস্তাব সমর্থন করবেন।

লেখক: ড. মো: শাহাদাৎ হোসেন মাহমুদ, মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব), স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট