“তামাকমুক্ত বাংলাদেশ” লক্ষমাত্রা অর্জনে সুপারিশ

বাংলাদেশকে আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটি পদক্ষেপ। তবে একাজ নিসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং এবং পরিকল্পিত সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। বাংলাদেশে ৪৩ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৪ কোটি ১৩ লক্ষ মানুষ তামাক ব্যবহার করে। তামাকমুক্ত দেশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আগামী ২০৪১ সালের মাঝে তামাকের ব্যবহার ০৫% এ নিয়ে আসতে হবে। তামাকমুক্ত লক্ষমাত্রা অর্জনের আগে বাংলাদেশেকে আরো দুটি আন্তর্জাতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। ২০২৫ সালে মাঝে অসংক্রামক রোগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২৫% এবং সাসটেনেবল ডেভলাপমেন্ট গোল (এসডিজি)-র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ৩০% তামাক ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে।

তামাক ব্যবহার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে কিছু প্রসঙ্গ প্রথমেই তুলে ধরা প্রয়োজন। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে অনেক অগ্রগতি সাধিত হলেও, অসংক্রামকরোগজনিত (হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, ডায়বেটিস) মৃত্যু আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। বর্তমানে মোট মৃত্যুর ৬৭% হয়ে থাকে অসংক্রামক রোগের কারণে। আর তামাক ব্যবহারকে অসংক্রামক রোগ সৃষ্টির অন্যত মপ্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ অবস্থায় তামাক ব্যবহার কমিয়ে আনতে চাহিদা ও যোগান উভয়ে দিকেই সরকারের নজর দেয়া প্রয়োজন। তামাকমুক্ত দেশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বর্তমান সময়ে যে সকল বিষয়গুলোর উপর নজর দেয়া প্রয়োজন।

১) জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী গ্রহণ:
বিগত ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের সরকার তামাকজাত দ্রব্যের উপর ১% স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আরোপ করে। ২০১৭ সালে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জের অর্থ ব্যয়ের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০১৭ প্রণয়ন করা হয়। এ নীতিমালা অনুসারে একটি জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী গ্রহণ করে তামাক নিয়ন্ত্রণে এই অর্থ ব্যয়ের নির্দেশনা রয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর আওতায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদের কর্মসূচী গ্রহণ করা জরুরি।

২) খসড়া জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি চুড়ান্ত করা:
বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আইন থাকলেও, এখনো কোন নীতি নেই। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি খসড়া জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়নের কাজ করছে। এ নীতিটি দ্রুত চুড়ান্ত করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ কাজ করতে এই নীতিটি দিকনির্দেশনা দিবে।

৩) খসড়া জাতীয় তামাক চাষ নীতি চুড়ান্ত করা:
বাংলাদেশে তামাক চাষ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে খাদ্য উৎপাদনযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে। এছাড়া তামাক পাতা শুকানোর জন্য কাঠ এবং অন্যান্য উপকরণ পোড়ানোর প্রেক্ষিতে বনভুমি উজারের পাশাপাশি পরিবেশ ধ্বংশ হচ্ছে। দেশের খাদ্য উৎপাদনযোগ্য জমি রক্ষায় তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে প্রণীদ খসড়া নীতিমালা চুড়ান্ত এবং বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। সুপ্রিম কোট ইতিমধ্যে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা প্রদান করেছে।

৪) তামাক কোম্পানির হতে সরকারের শেয়ার প্রত্যাহার:
তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের ইতিবাচক পদক্ষেপ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এমতবস্থায় বিএটিতে সরকারের শেয়ার তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। দ্রুততার সাথে তামাক কোম্পানি হতে সরকারের শেয়ার প্রত্যাহারে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

৫) তামাক কোম্পানির প্রভাব নিয়ন্ত্রণে গাইড লাইন প্রণয়ন:
তামাক কোম্পানিগুলোর তাদের নিজস্ব ডকুমেন্টে স্বীকার করেছে যে তারা নানাভাবে সরকারের নীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিতে কোম্পানির প্রভাব বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি এফসিটিসি-র আর্টিকেল ৫.৩তে সুপষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ চুক্তির পক্ষভুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিতে কোম্পানিগুলোর অনৈতিক প্রভাব নিয়ন্ত্রণে দ্রুত একটি গাইডলাইন প্রণয়ন প্রয়োজন। এ গাইডলাইন জনপ্রতিনিধি এবং জনসেবকদের তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি সুরক্ষায় দিক নির্দেশনা প্রদান করবে।

৬) স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্তকরণে গাইডলাইন তৈরি:
তামাক নিয়ন্ত্রণকে স্থানীয় পর্যায়ে জোরদার করতে স্থানীয় সরকার সংস্থা যেমন সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদকে সম্পৃক্ত করা জরুরি। ইতিমধ্যে অনেক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান তামাকের খুচরা বিক্রয় নিয়ন্ত্রণে লাইসেসিং, তামাক নিয়ন্ত্রণ কাজের জন্য বাজেট বরাদ্ধ এবং আইন বাস্তবায়নে কাজ করছে। দেশব্যাপী সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে সমন্বয়ের লক্ষ্যে দ্রুত একটি গাইডলাইন প্রণয়ন জরুরি।

৭) তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধিতে নীতিমালা প্রণয়ন:
তামাক ব্যবহার কমিয়ে আনতে কর বৃদ্ধি একটি কার্যকর উপায়। প্রতিবছর সকল পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য সে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের তামাক, জটির মূল্যস্তর এবং কর কাঠামোর কারণে তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি করা হলেও তা ব্যবহারকারীদের উপর প্রভাব ফেলে না। কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাক ব্যবহার কমিয়ে আনতে দেশে একটি জাতীয় কর নীতি প্রণয়ন করা জরুরি।

৮) অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নিকট তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ:
বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশই তরুণ। অর্থাৎ ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা হলো প্রায় চার কোটি ৭৬ লাখ। ২০৬১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা পাঁচ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। ২০১১ সালে যে সংখ্যাটি ছিল ১ কোটি ১২ লাখ, তা ২০৬১ সালে আনুমানিক ৫ কোটি ৫৭ লাখ হবে। বর্তমান যুবদের মাঝে তামাক ব্যবহার কমাতে পারলে আগামী দিনের প্রবীনদের মাঝে তামাকজনিত রোগ ও মৃত্যু কমে আসবে । বিদ্যমান আইন অনুসারে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নিকট তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ সংক্রান্ত বিধান কঠোরভাবে বাস্তবায়ন জরুরি।

৯) তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ৯০% ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদান:
মোড়কে ছবিসহ সতর্কবানী যুবকদের তামাক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করে এবং এটি বিনামুল্যে তামাক বিরোধী প্রচারণার একটি কৌশল। বিদ্যমান আইন অনুসারে সরকার তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের সতর্কবাণী ৯০% এ উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। দক্ষিন এশিয়ার অনেক দেশই ইতিমধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে বড় ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবানী প্রদান করেছে।

১০) তামাকের স্ট্যান্ডার্ড মোড়ক প্রর্বতন ও খুচরা বিক্রি বন্ধ:
বাংলাদেশ অধিকাংশ ব্যক্তিই খুচরা সিগারেট ক্রয় করে ফলে সরকার রাজস্ব প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হয় এবং ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবানী প্রদানের উদ্দেশ্য কাজে আসে না। সরকারের উচিত দ্রুত খুচরা সিগারেট বিক্রয় বন্ধ করা। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের কৌটা ও মোড়কের কারণে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবানী কাজে আসছে না। এমতবস্থায় দেশে তামাকজাত দ্রব্যে বিক্রয়ের জন্য কৌটা ও মোড়কে সাইজ নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন।

১১) তামাক বিক্রয়ের লাইসেসিং:
বাংলাদেশের যত্রতত্র তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করা হয়। ছোট/বড় এ সকল বিক্রিতাদের নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশে পাশে এ ধরনের বিক্রয় কেন্দ্র বেশি পরিলক্ষিত হয়। অনেক দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে তামাক বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত তামাক বিক্রয়ের লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা। এ পদক্ষেপ অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নিকট তামাক বিক্রয় বন্ধ করার পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবে।

১২) বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন:
পাবলিক প্লেস ও পরিবহনের ধূমপান বন্ধের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হলেও, তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ সংক্রান্ত বিধানসহ অনেক বিধানগুলোই তামাক কোম্পানি লঙ্ঘন করছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়মিত মনিটরিং করা প্রয়োজন। বিদ্যমান আইন বাস্তবায়নে প্রতিবছর একটি লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

লেখক: আইনজিবী-নীতি বিশ্লেষক ও কারিগরী পরামর্শক, দি ইউনিয়ন।