তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য মনিটরিং বৈজ্ঞানিকভাবে ও সরকারের উদ্যোগে নিয়মিতভাবে করা দরকার -সাক্ষাৎকারে ডা. মোস্তফা জামান

প্রশ্ন: তামাক নিয়ন্ত্রণে আপনার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে কিছু বলুন?

ডা. মোস্তফা জামান: আমি যেহেতু হৃদরোগ প্রতিরোধে কাজ করে আসছি, তখন থেকেই তামাক নিয়ন্ত্রণেও কাজ করছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ২০০৩ সালে যোগ দেয়ার পর জাতীয় পর্যায়ে কাজ শুরু করি। সে অর্থে আমি ২০০৩ সন থেকে জোরালোভাবে কাজ করছি।

প্রশ্ন: গত ১৪ বছর সময়কালে কোন কোন পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে?

ডা. মোস্তফা জামান: ২০০৩ সন বা কাছাকাছি সময়ে যখন বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন হতো, অনেকে বিষয়টাকে হালকাভাবে নিতেন। এর আগে আধূনিক কাজ করলেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ জনপ্রিয় ছিল না। সে সময়ে টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সিগারেটের বিজ্ঞাপন চলত। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কোন লক্ষনীয় ভূমিকা ছিল না। তখন উপলব্ধি করি; নীতিগত পরিবর্তন আনতে হবে। ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট, বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটসহ সবার সহযোগিতায় আমরা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রস্তুতের কাজ করি। ২০০৫ সালে প্রথম তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাশ হয়। ২০০৬ সনে এর বিধি তৈরী হয়। কিন্তু, সে আইন আংশিক ছিলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল এর আলোকে অনেক কিছু আইনটাতে ছিল না। আইনে ধোঁয়াবিহীন তামাকের কথা বাদ পড়ে। সেটা পরিবর্তন করার জন্য সামাজিক আন্দোলন আবার চলতে থাকে। ২০১৩ সনে আবার ২০০৫ সনের আইনটা সংশোধিত হয় এবং ২০১৫ সালে তার বিধি প্রণীত হয়। এবার আইনটি অনেকটা পরিপূর্ণতা লাভ করে। স্বাস্থ্য নীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ গুরুত্ব পেয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও তার আলোকে দেশের ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তামাক নিয়ন্ত্রণ যুক্ত হয়েছে।

শিশুরা বিদ্যালয়ে যেসব পাঠ্য বই পড়ে; সেখানে তামাকের বিষয়ে এখন অনেক বক্তব্য এসেছে। এখন বাচ্চারা যখন উচ্চস্বরে পড়াশোনা করে তাদের বাবা-মায়েরা সচেতন হচ্ছে। এখন পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে আগের মত ধূমপান চোখে পড়ে না। অধূমপায়ীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেউ প্রতিবাদ করলে ধূমপায়ীরা বিরত থাকেন। আজকাল অধিকাংশ বাসার ড্রয়িংরুমে এসট্রে দেখা যায় না। বাড়ীগুলো ধূমপানমুক্ত হচ্ছে। আগে রাস্তা-ঘাটে, দোকানে, মার্কেটে সিগারেটের বিলবোর্ড চোখে পড়তো। কিন্তু আইন পাসের পর এগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলো বড় ধরনের পরিবর্তন। আইন বাস্তবায়নে মূল শক্তি জনসাধারণ। পাশাপাশি বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট, অন্যান্য অনেক সংগঠন কাজ করছে। এটাও একটি বিরাট পরিবর্তন।

প্রশ্ন: কোন কোন জায়গাগুলোতে চ্যালেঞ্জ মনে হয়েছে?

ডা. মোস্তফা জামান: তামাক কোম্পানিগুলোর বাধা কঠিন চ্যালেঞ্জ। অনেক সময়, কোম্পানি সরাসরি দৃশ্যে না এসে সমাজে প্রতিষ্ঠিত তাদের কিছু এজেন্ট দিয়ে কাজ করে। কোন কোন গবেষকও তামাকের পক্ষে কথা বলেন। কিন্তু, সেসব গবেষণা বাস্তবে জার্নালে দেখতে পাই না। সরকারের মধ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব ছিল না। কিন্তু, ২০১৩ সনের আইন হওয়ার পরে এখন সরকারের কর্ণধাররাই বলছেন যে, তামাকের কর বাড়াতে হবে। এখানে আর বিড়ি ইন্ডাষ্ট্রি থাকতে দেয়া যায় না। আমাদের আগের কাজগুলো ফল দিতে শুরু করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, ২০৪০ সনের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করবেন। সুতরাং তাঁর সাথে যারা আছেন তারা সবাই একইভাবে কাজ করবেন এবং তার প্রতিফলন ঘটছে বলে প্রতীয়মান হয়।

প্রশ্ন: ২০০৮ সালে যখন এমপাওয়ার পলিসি প্যাকেজ ঘোষণার পর থেকে এ সময়কালে বাংলাদেশে মনিটরিংয়ে কোন কোন কাজ হয়েছে বলে মনে হয়? মনিটরিংয়ে আরও কি হওয়া উচিত ছিল?

ডা. মোস্তফা জামান: মনিটরিং এর দুটো দিক; এক. তামাকের ব্যবহার মনিটরিং; দুই. নীতি ও আইন যা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন ও ফলাফল মনিটরিং। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা তামাক নিয়ন্ত্রণে যারা অনুদান প্রদান করেন (যেমন ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রোপিস) তাদের অনুদানে কিছু কিছু জরিপ/গবেষণা হচ্ছে। ২০০৯ সনে গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে করা হয়েছে। ২০০৪ সনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় অর্থনৈতিক ক্ষতি বা স্বাস্থ্যগত ক্ষতি গবেষণা হয়েছে, এ স্টাডি আমিই নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। যা বাংলাদেশে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে গতিশীল করে। ২০১০ সনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্টেপ সার্ভে হয়, যেখানে তামাক ব্যবহারের উপর কাজ করা হয়। এরপর ২০১৩ সনে কিছু কাজ করা হয়।

মনিটরিং সরকারের কাজ হিসেবে নেওয়া দরকার; সেটা এখনো নেওয়া হয়নি। সরকার তার নিজস্ব অর্থায়নে এবং নিজস্ব পদ্ধতির মধ্যে বা তার যে ব্যবস্থাপনা আছে তার মধ্য থেকে সবসময় উপাত্ত জেনারেট করতে হবে। অন্তত ৫ বছরে একবার জাতীয়ভিত্তিক হতে হবে। আশার বিষয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) এর সাথে কাজ করছি। আরেকটা গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে হচ্ছে। আশা করছি পরবর্তী সময়ে সরকারের টাকায় বিবিএস যে জরিপগুলো করবে তার মধ্যে তামাক একটি হবে। শুধু তামাকের উপর সার্ভে না করেও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অন্যান্য বড় যেসব সার্ভে রয়েছে তার মধ্যে তামাকের কিছু উপাত্ত সংগ্রহ করা যায়।

নিপসম, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বিএসএমএমইউ যে কাজগুলো করেন তার মধ্যেও তামাকসম্পর্কিত জরিপ/গবেষণা অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার। অনেক সময় জাতীয়ভাবে জরিপ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট জরিপ করা সম্ভব। বিবিএস-এর প্রাইমারী স্যাম্পলিং ইউনিট-এর সহায়তা নিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে বাছাই করে কাছাকাছি সময়ে যদি অনেকগুলো সংস্থা নিজ নিজ এলাকায় জরিপ করেন, সেগুলো একসাথে করলে একটা জাতীয়ভিত্তিক ফলাফল পাওয়া সম্ভব। আমি মনে করি নিজস্ব অর্থায়নেই তামাক ব্যবহারের হার নিয়মিতভাবে মনিটর করা সম্ভব।

তবে তথ্যগুলো যেন উচ্চমানের হয়, এসব তথ্য যেন একটার সাথে আরেকটা তুলনা করার মত হয়, সবগুলো যেন একসাথে মিলানো সম্ভব হয় সেজন্য একটা একীভুত পদ্ধতি ব্যবহার করা দরকার। আগামী দিনে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা ও কর্মশালা করার ইচ্ছা আছে, যাতে যে যার জায়গা থেকে তথ্য তৈরী করতে পারেন। আমি বিশ্বাস করি, সেদিক থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভূমিকা রাখতে পারবে যাতে বাংলাদেশে উচ্চমানের, বিশুদ্ধমানের তথ্য তৈরী হয়।

বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন মনিটরিংয়ের দায়িত্ব টাস্কফোর্স ও এনটিসিসিকে দেয়া আছে। তামাকের কর বিষয়ক মনিটরিং যেন ভালো হয় সেজন্য টোব্যাকো ট্যাক্স সেল করেছিলাম। এ সেল সঠিকভাবে কাজ করলে আমাদের ইন্ডাষ্ট্রি মনিটরিং করা সহজ হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড টোব্যাকো ট্যাক্স সেল নামে না হলেও অন্য ফরমেটে এই কাজগুলো করছেন।

প্রশ্ন: ২০০৪ সালের আপনার নেতৃত্বে যে গবেষণা হয়েছিলো, যার তথ্য (তামাকের কারণে প্রতিবছর ৫৭,০০০ হাজার জনের মৃত্যু) এখনও ব্যবহার হয়। এ তথ্য আইন প্রণয়নে একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল। এধরনের তথ্য আমরা আরো কিভাবে পেতে পারি?

ডা. মোস্তফা জামান: আপনি জেনে খুশি হবেন, ইতোমধ্যে প্রাথমিককাজ শুরু করেছে। আমার কাজ সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দেয়া, আমার রোলটাই এডভাইজারি।

প্রশ্ন: আইনের বেশ কিছু ধারা এমপাওয়ারের অন্তর্ভুক্ত। আইন বাস্তবায়ন মনিটরিং কিভাবে কার্যকর করা যায়?

ডা. মোস্তফা জামান: জেলা টাস্কফোর্স আইন বাস্তবায়নে কি করছেন টোব্যাকো কন্ট্রোল সেল-এ প্রতিবেদন আসার কথা। এর আগে দেখেছি, এসব প্রতিবেদন মোবাইল কোর্টকেন্দ্রিক। কিন্তু আইন বাস্তবায়নতো শুধু মোবাইল কোর্ট না। বরং, টাস্কফোর্স কমিটিগুলো কিভাবে সভা করছেন, কিভাবে পরিদর্শন করছেন, তারা কিভাবে আইন বাস্তবায়নে কাজ করছেন সেটা আরো পরিকল্পিত উপায়ে যদি জানা যায় তাহলে উপকৃত হবে। আমাদের যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো আছে আইন বাস্তবায়নে তাদের অধিকতর দায়িত্ব দেয়া যায়। জনপ্রতিনিধি বা সরকারের অন্যান্য যে অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আছে তাদের ভূমিকা জোরালো করতে হবে। সেজন্য জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটি যদি সক্রিয় হয়, তাহলে ক্রমান্বয়ে জেলা এবং উপজেলা টাস্কফোর্সও সচল হবে। এটা সম্ভব হলে আইন মনিটরিং কার্যকর করা সম্ভব। কিন্তু এর মূল দায়িত্ব এনটিসিসি’র, কিন্তু আমরা সবাই জানি এনটিসিসি’তে যথেষ্ট পরিমান জনবল নাই। এর জনবল আরো বাড়ানো দরকার। শতকরা ১% যে স্বাস্থ্য উন্ন্য়ন কর আসছে, তা যদি ওখানে ব্যবহার করা যায়, তাহলে তো আর জনবল সঙ্কট হওয়ার কথা না।

এনটিসিসি যেন একটি পূর্ণাঙ্গ অফিসে পরিণত হয়। যেখানে যথেষ্ট জনবল থাকবে। প্রয়োগ করার মত ক্ষমতা থাকবে। সেজন্য আমাদের যে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল আছে এটাকে শক্তিশালী করতে হবে।

প্রশ্ন: ধূমপানমুক্ত স্থান/পরিবহন নিয়ে এখন বাংলাদেশে কি অবস্থায় আছে? আইনের এ ধারা বাস্তবায়নে আর কী করা দরকার?

ডা. মোস্তফা জামান: আইনে যা আছে এটা যথেষ্ট শক্তিশালী। একটা বিষয়, ম্যানেজার যদি ইচ্ছা করেন তাহলে একাধিক কক্ষবিশিষ্ট পাবলিক প্লেস/পরিবহনে ধূমপানের জন্য জায়গা করে দিতে পারবেন। কিন্তু তিনি যদি না করেন, তাহলে তো সেটা ধূমপানমুক্ত এলাকা হিসেবেই থাকবে। আমার জানা মতে, খুব কম জায়গা হয়েছে যেখানে কেউ ধূমপানে জন্য আলাদা করে জায়গা তৈরী করে দিয়েছেন। ধূমপান স্থানের বিষয়টি জনপ্রিয়তা পায় নাই। আইন বাস্তবায়নে লোকজন কিছু কিছু সমস্যার মুখোমুখি হন। যেমন; যিনি কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার অনুপস্থিতিতে মামলা করা বা শাস্তি দেওয়ার কোন বিধান নেই। এ সম্যস্যাগুলো বের করে যদি আবার এ আইনের সংশোধন বা কিছু সংযোজন করা হয় তাহলে এটা আরো কঠিনভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

প্রত্যেকটা শিক্ষায়তন, শপিংমল, অফিস যদি ধূমপানমুক্ত বা তামাকমুক্ত করার জন্য একজন ফোকাল পার্সন নির্দিষ্ট করা যেত। যিনি অন্যের উপর দোষ না চাপিয়ে, শাস্তি না দিয়ে বরং তাদের সহযোগিতা করবেন যেন সংশ্লিষ্ট স্থান ধূমপানমুক্ত/তামাকমুক্ত থাকে। তাহলে এ কাজ জোরালো হতে পারে। এনজিওরা খুব ভালো কাজ করতে পারেন বলে আমি মনে করি। এনজিওদের এডভোকেসির ফলে রমনা থানার মত থানাকেও ধূমপানমুক্ত ঘোষণা করা হয়, যেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তাঁর অধীনস্থ সমস্ত অফিসকে ধূমপানমুক্ত করার নির্দেশনা দিয়েছেন। এনজিওদের তামাক নিয়ন্ত্রণের কাজটাকে সবাই সম্মান করেন।
আমরা মডেল করতে পারি। কোন ছোট এলাকা বেছে নিয়ে সেখানকার প্রত্যেক অফিসে একজন করে ফোকাল পয়েন্ট সুনির্দিষ্ট করে তাকে তামাক নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় সব উপকরণ (পোস্টার, ষ্টিকার, লিফলেট, সাইনবোর্ড) দিয়ে সেখানে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করতে পারি। ফোকাল পার্সন ওখানকার ম্যানেজার বা মালিকের আইনী দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিবেন, নো-স্মোকিং সাইনেজগুলো সঠিকভাবে লাগানোর জন্য সহায়তা করবেন। মানুষ যেন মেনে চলে নেই লক্ষ্যে কাজ করবেন। তাহলে আমার মনে হয়, আইনের এ ধারা তথা এমাপাওয়ার-এর এই অংশ খুব ভালোভাবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে। এর সাথে মনিটরিংও জড়িত আছে। কাজটা হচ্ছে কি না, সেটি বোঝার জন্য একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে বাতাসের মান পরীক্ষা, সিগারেটের নিকোটিন আছে কি না, যাচাই করা। বাতাসের মান বলতে, তামাকের ধোঁয়ার সাথে যে ক্যামিক্যাল বের হয় সেগুলো ক্রমান্বয়ে কমে এসেছে কি না, সেটি দেখা। জাতীয়ভিত্তিক না হলেও এলাকাভিত্তিক কিছু করা প্রয়োজন।

এসটিসিসিতে যদি হটলাইন চালু করা যায়, কোথাও আইনের লঙ্ঘণ হলে যেন তাৎক্ষনিকভাবে এসএমএস এর মাধ্যমে যে কেউ জানাতে পারেন। এনটিসিসিতে যিনি দায়িত্বে থাকবেন তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। এরকম একটা সমন্বয় যদি করা যায়, তাহলে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহন ধূমপানমুক্ত হয়ে যাবে। যে অবস্থা ২০০৩ সন বা তার আশেপাশের সময়ে দেখেছিলাম এখন তার চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। ২০১৩ সনের আইনটি হওয়ার পরে রাস্তা-ঘাটে ধূমপান বেড়ে গিয়েছিলো। এর বড় কারণ, ধূমপায়ীরা কোন পাবলিক প্লেস, তাদের ঘরবা পরিবহনে ধূমপান করতে পারতেন না। ফলে ধূমপায়ীরা রাস্তায় গিয়ে ধূমপান করতেন। যেসব দেশে ধূমপানমুক্ত স্থান/পরিবহনের ধারা কঠিনভাবে বাস্তবায়ন হয়, সেসব দেশে রাস্তায় দৃশ্যমান ধূমপান বাড়ার ঘটনাটি ঘটেছে। এটিও এখন কমে গেছে বলে আমার ধারণা।

প্রশ্ন: তামাক বর্জনে সহায়তা (অফার টু কুইট) বিষয়ে বেশি কাজ করা হয়নি। এটা নিয়ে বাংলাদেশে আমাদের কি করা দরকার?

ডা. মোস্তফা জামান: এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যারা ধূমপান বা তামাক ব্যবহার করেন না তারা যেন আর শুরু না করেন। এটা মূলত অল্প বয়সীদের টার্গেট করে করা হয়। একটু বয়স্ক, যারা তামাক ব্যবহার করেন তাদেরকে ওখান থেকে ফিরিয়ে আনার কাজটা কঠিন। কারণ, নিকোটিনের নেশা খুবই কঠিন। তবে যদি কেউ মনে করে আমি আজই ছেড়ে দেব, তার মনোবল যদি অত্যন্ত শক্তিশালী হয় তাহলে তিনি ছেড়ে দিতে পারবেন। কিছু সমস্যা হবে; মেজাজ খিটখিট করবে, শরীর কামড়াবে/মোচড়াবে, অশান্তি লাগবে, ঘুম আসবে না। কিন্তু, এটি বেশিদিন থাকবে না, বড়জোড় এক সপ্তাহ থাকবে এমন অনুভুতি। এই এক সপ্তাহ যদি তিনি টিকে যান, তাহলে সবসময়ের জন্য টিকে যাবেন বলে আমি মনে করি।

২০০৭-০৮ সনের দিকে অন্যদের সহায়তায় স্মোক ফ্রি হসপিটাল নেটওয়ার্ক চালু করেছিলাম। যেখানে বসে সাক্ষাতকার দিচ্ছি, বাতজ্বর হাসপাতাল, এটিও ধূমপানমুক্ত হাসপাতাল নেটওয়ার্কের সদস্য। হাসপাতালে রোগী বা বাইরের লোকজন এসে ধূমপান করতেন না, এখানে যারা চাকুরি করেন তারাই লুকিয়ে ধূমপান করতেন। ওই ঘোষণার পরে হাসপাতালে ধূমপান বন্ধ হয়। হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল, বক্ষব্যাধি হসপিটাল, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, হৃদরোগ হাসপাতাল, মানসিক রোগ নিরাময় হাসপাতালÑ আরো অনেকেই জয়েন করেছেন। হাসপাতালগুলো যৌথ ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন। সে সময় থেকে হসপিটালে আর কেউ ধূমপান করেন না। এটাকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারি নাই। এজন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি শক্তিশালি ভূমিকা নেয়া দরকার। ওনারা একটা নোটিশ আগে পাঠিয়েছেন, এখন এর ফলোআপ করা প্রয়োজন। এখনো হসপিটালের আনাচে-কানাচে সিগারেটের বাট পড়ে থাকতে দেখা যায়। হসপিটালের ভিতরে ছোট দোকানগুলোতে সিগারেট বিক্রি হয়। হসপিটালের ক্যাম্পাসের ভিতরে সিগারেট বা তামাকজাত পণ্য বিক্রয় করতে দেয়া উচিৎ নয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে যে, ডাক্তার, নার্স বা কর্মীরা রোগীদেরকে কাউন্সেলিং করবে, উপদেশ দেবেন এবং কথা-বার্তা গুলো এমনভাবে বলবেন যাতে করে খুব ইমিডিয়েটলি তারা খুব ইমপ্লেসড হয়ে যান এবং তামাক ব্যবহার করা ছেড়ে দেন।

তবে স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন চিকিৎসক, নার্স, প্যারামেডিক্স বা স্বাস্থ্যকর্মী তাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষকে তামাকের ব্যবহার থেকে ফিরিয়ে আনা। এটিকেই ‘সিজেশান’ বা ‘নিবৃতকরণ’ বলা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যদি ডাক্তাররা তিন মিনিট, নার্সরা ৫ মিনিট কথা বলেন, তাহলে শতকরা ৮০ ভাগ ব্যবহারকারী তামাক ছেড়ে দেন। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, তাদের কাছে যখন রোগিরা যান তখন তারা রোগী হিসেবে যান। কোন না কোন সমস্যা নিয়ে যান। এই একটি অপুরচুনিটি বা সুযোগ। আমার গ্রামে একটি ছোট হেলথ সেন্টার আছে, সেখানে যারা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে আসেন তাদেরকে কাউন্সেলিং করে দেখা গেছে, প্রায় ৭৫% দ্বিতীয় ভিজিটেই, ৪-৫ সপ্তাহের মধ্যেই তামাক ছেড়ে দেন। বাকি ২৫% লোককে প্রতিমাসে ১বার হলেও বলার ১ বছর সময় পার হলে এটি প্রায় শূন্যের কাছে চলে আসে। ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীরা কাউন্সেলিং করেন তাহলে তামাক ছেড়ে দেয়া সম্ভব। আমাদের ১৩ হাজারের মত কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। আমি যে অভিজ্ঞতার কথা বললাম, সেই অভিজ্ঞতা কমিউনিটি ক্লিনিক করতে পারেন। কমিউিনিটি ক্লিনিকে যারা কাজ করেন, বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করেন তারা যদি লিস্ট তৈরী করে তামাক ব্যবহার বা ধূমপান করে যারা তাদেরকে মোবাইল ফোনে বা সরাসরি কাউন্সেলিং করা যায়, তাহলে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক লাফে অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব।

প্রশ্ন: আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী একটা ঘোষণা দিয়েছেন যে, মেডিকেল স্টুডেন্ট ভর্তির ক্ষেত্রে অধূমপায়ী হতে হবে। এটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

ডা. মোস্তফা জামান: এটি অত্যন্ত উৎসাব্যঞ্জক মনে করি। এটি সবার জন্য প্রেরণা। যারা ভর্তি হতে আসবেন অন্তত ভর্তি পরিক্ষা দিতে আসার সময়ও চিন্তা করবেন আমি হয়তো বা সুযোগ পাবো না। সে অর্থে অনেক লোক ধূমপান ছেড়ে দিবেন। কোন সংস্থা যখন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় যে আমরা ধূমপায়ীদের নিয়োগ দিই না। যারা ধূমপান করেন তারা ঐদিন ধূমপান ছেড়ে দিয়ে পরিক্ষা দিতে যাবে। যেমন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলো পরিস্কার দেখবেন যে, ওখানে ধূমপায়ী ও তামাক ব্যবহারকারীদের নিয়োগ দেয়া হয় না। আর নিয়োগ পরীক্ষায় একটা প্রশ্ন থাকে যে আপনি ধূমপান করেন কি না? না হলে তো নাই, যদি হ্যাঁ হন তাহলে আপনি চাকুরি পেলে ধূমপান ছেড়ে দিবেন কি না? সেখানে আপনাকে হ্যাঁ/না আপনাকে উত্তর করতে হবে। যদি আপনি না উত্তর করেন। তাহলে আপনার দরখাস্তই সেখানে গ্রহণ হবে না। এইভাবে আমরা প্রত্যেকেই যদি এগিয়ে আসি, শুধু মেডিকেল ভর্তি কেন, ইউনিভার্সিটিতে যারা পড়েন, নার্সিংয়ে যারা পড়তে যান তাদের প্রত্যেকের জন্যই আমরা ক্রমান্বয়ে এটি করতে পরি। যারা অলরেডি সরকারি চাকুরীতে আছেন তাদের বেলায়ও এটি প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ।

প্রশ্ন: ২০১৬ সাল থেকে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের ৫০% স্থানে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর প্রচলন হয়েছে। এই পরিবর্তন ও বাস্তবায়ন কিভাবে মূল্যায়ন করছেন?

ডা. মোস্তফা জামান: তামাক নিয়ন্ত্রণে যারা কাজ করছেন তাদের একটা বিরাট সাফল্য। ২০০৫ সনের আইন হওয়ার পর ৩০ ভাগ স্থানজুড়ে লিখিত সতর্কবাণী আসে। যারা পড়াশোনা জানেন না তারা তামাকের ক্ষতিকর বার্তা পেতেন না। সেই কারণে ছবি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার একটা প্রয়োজনীয়তা আসে। যেটি পৃথিবীর অনেক দেশেই ইতোমধ্যে হয়েছে। ২০১৩ সনের আইনে বাংলদেশে প্যাকেটের অর্ধেক পরিমাণ জায়গায় সচিত্র সতর্কবাণী প্রিন্ট করার বিধান চালু হয়।

আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও এটি একটি বড় পদক্ষেপ। তবে বিড়ি, জর্দ্দা বা গুলের কৌটায় সচিত্র সতর্কবাণীর প্রকাশ করা একটি চ্যালেঞ্জ। এসব কোম্পানি আইন মানছে না। কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করা যাদের কাজ তারা এ বিষয়ে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে বলে মনে করি না। প্রত্যেকটা বিড়ির প্যাকেট, জর্দা/গুলোর কৌটায় তাদের মালিকের ছবি থাকে। কোম্পানির মালিকের ফটো ছাপতে কোন অসুবিধা দেখি না। কিন্তু সচিত্র সতর্কবাণী ছাপে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় হলেও মূলত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এ কাজটি দেখার কথা, কারণ তারা তামাক কোম্পানিকে মনিটরিং করেন। এক্ষেত্রে জোরালো মনিটরিং ও বাস্তবায়নে বাধ্য করার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে হবে।

প্রশ্ন: এখনতো প্লেইন প্যাকেজিং (সাদামাটা মোড়ক) এর প্রচলন শুরু হয়েছে। অষ্ট্রেলিয়া ২০১২ সালে শুরু করেছে। বেশ কয়েকটি দেশে চলে এসেছে। বাংলাদেশে পরবর্তী সংশোধনী করতে গেলে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মী হিসেবে আমরা প্লেইন প্যাকেজিং অবশ্যই চাইবো। না হলে অন্তত ৯০% স্থান জুড়ে সচিত্র সতর্কবাণী। আপনার প্রত্যাশা কি?

ডা. মোস্তফা জামান: আমার প্রত্যাশা একেবারেই সাদামাটা মোড়ক। নেপালের মত দেশ শতকরা ৯০ ভাগ প্রয়োগ করছেন, আর আমরা এখনও শতকরা ৫০ ভাগে পড়ে আছি। নেপাল থেকে উন্নয়নের প্রায় সবসূচকে আমরা এগিয়েছি, কিন্তু এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকব এটা ভাল দেখাবে না। তাছাড়া আমরা তাদের অনেক আগে এফসিটিসি স্বাক্ষর করেছি, অনুসমর্থন করেছি। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাও আমাদের চাইতে অনেক এগিয়েছে, সে বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্টদের নজরে আনতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভাবমুর্তি রক্ষা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য তামাকের মোড়কের সচিত্র সতর্কবাণী বড় বা সাদামাটা করতে হবে।

প্রশ্ন: তামাকের মোড়কে সতর্কবাণী তিন মাস পরপর পরিবর্তন করার কথা। উৎপাদনের তারিখ না থাকায় আমরা বুঝতে পারছি না সতর্কবাণী পরিবর্তন হচ্ছে কি না। এটা কিভাবে দেখছেন?

ডা. মোস্তফা জামান: যারা কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের পক্ষে এটা মনিটর ও বাস্তবায়ন সম্ভব। তুরস্কের মত দেশে কয়টা শলাকা তৈরী হচ্ছে মেশিন অটোমেটিক্যালী মেসেজ দিচ্ছে। এখন তো আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ বলি। কোথায় কোন প্রেসে কি প্রিন্ট হচ্ছে গেট পার হওয়ার আগেই তার তথ্য চলে আসা সম্ভব। তামাকের মোড়কে উৎপাদনের তারিখ থাকা আবশ্যক।

প্রশ্ন: সরকার বলছে, বাংলাদেশে তামাকের কর প্রতিবছর বাড়ছে। কিন্তু গড় আয় বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফিতীর চাইতে দাম বাড়ছে না। ফলে তামাক অন্যান্য পণ্যের তুলনায় সস্তা হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যমান কর ব্যবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

ডা. মোস্তফা জামান: এটা খুবই হতাশাজনক। পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক দেশ এতগুলো স্তরের ব্যবহার করে। এত স্তর থাকার কারলে তামাক কোম্পানি কর ফাঁকি দেয়া বা প্রতারণা করার সুযোগ পায়। আমরা ২০০৩ সন থেকে পরিস্কার বলে আসছি যে সব তামাক পণ্যের জন্য সমান হবে। তামাকের কর এমনভাবে হতে হবে যাতে মূদ্রাস্ফীতি (২০১৬ সালে শতকরা ৬ শতাংশ) ও মানুষের গড় আয়ের (২০১৬ সালে ৯ শতাংশ) চাইতে তামাকের মূল্য বেশি বাড়তে হবে। তাহলে এটার দাম বাড়বে। দেখা যায় যে, তামাকের কর বেড়েছে ৩ – ৫ ভাগ, যা মুদ্রাস্ফিতী ও গড় আয় বৃদ্ধির চাইতে কম। ফলে ক্রমান্বয়ে তামাক পণ্যগুলো সস্তা হচ্ছে। সস্তা বলছি এই জন্য, এটা একটা রিলায়েটিভ বিষয়। ইনকাম বাড়ছে, কিন্তু দাম বাড়ছে না সেই জন্য এটি সস্তা হচ্ছে। নমিনাল প্রাইস, প্রকৃত দাম হয়তো বেড়েছে। কিন্তু রিলায়েটিভ প্রাইস কমেছে। সেজন্য তামাকের কর বাড়াতে হবে। শুধু সিগারেট নয়, বিড়ি-জর্দা-গুলের দিকেও তাকাতে হবে।

প্রশ্ন: তামাকের কর যে বাড়ছে কোন ভিত্তিতে বাড়ছে, সেটি আসলে পরিস্কার না। এজন্য তামাক কর নীতি দরকার আছে কি না?

ডা. মোস্তফা জামান: তামাক কর নীতি অবশ্যই দরকার যে আমরা কিসের ভিত্তিতে, কত হারে, কত দিনে তামাকের কর বাড়াবো। আমি যেটি বলছি সেটি একেবারেই সাদামাটা। কম দামী তামাক পণ্যের ভিত্তিমূল্য কিভাবে বাড়ানো যায়, সরকার কিভাবে লাভবান হবে, সেই বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট কাজ করা, আলোচনা করার সুযোগ রয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছে, যারা এগুলো বাস্তবায়ন করেন তারা বদ্ধ দরজা, বদ্ধ জানালা রেখে কাজটি করতে ভালোবাসেন। এটি দরজা বন্ধ রেখে করার মত কাজ না। সকলে যেন অংশগ্রহণ করতে পারেন, সেভাবে মনের দরজা খুলে দেন তাহলে তামাক নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটা সহজ হবে। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশে যদি তামাক নিয়ন্ত্রণে একটি বিষয়ের ওপর জোর দিতে হয় সেটি হলো তামাকের কর।

প্রশ্ন: দেশে তামাক চাষ যে হয়, এখানে আমরা কর ব্যবহার করতে পারি কি না? তামাক রপ্তানীর উপর কর আছে। এটা বাড়ানোর কথা বলছি। তামাক উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যদি পরিবেশ কর, ভূমি কর অথবা আরো অন্য কোন প্রক্রিয়া করতে পারি কি না? যেমন: বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের উপদেষ্টা পরিবেশবিদ আবু নাসের খান তামাক চাষের উপর পরিবেশ কর আরোপের দাবী জানিয়ে আসছেন।

ডা. মোস্তফা জামান: তামাক চাষে পরিবেশ কর বা ভূমি কর আরোপের প্রস্তাবকে ইতিবাচক মনেকরি। এছাড়া তামাক কোম্পানিকে বাধ্য করতে পারি যে তারা তামাক চাষীদেরকে যে লোন দেয়, সেই লোন দেয়ার উপর কর আরোপ করা হবে। তার লেনদেনের নিশ্চয়ই কাগজপত্র আছে। এখানে উৎসে কর কর্তনের মত ওই জায়গায় কর আরোপ করতে পারি, তাহলে বিষয়টা সুবিধাজনক হবে। তামাক কোম্পানি চাষীদেরকে সার, কেমিক্যাল বা অন্যান্য জিনিস পৌছে দেন বা আগেই গিয়ে কিছু টাকা দিয়ে আসেন। এটা অনেকটা খারাপ কাজ করতে প্রলুব্ধ করার মত বিষয়। আমি যদি আপনাকে প্রলুব্ধ করি যে এই খারাপ কাজটা করে আসেন, আমি অপরাধ করছি না? তাহলে এটা যদি আমরা অপরাধ হিসেবে নির্দিষ্ট না করি তাহলে উৎসে এটাকে আপনি বন্ধ করতে পারবেন না।
তামাক কোম্পানি যেন দরিদ্র কৃষদের প্রলুব্ধ করতে তাদের লোন দিতে না পারেন সেটা কঠিনভাবে বন্ধ করা দরকার। সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক, কৃষি মন্ত্রণালয় বা অন্য যে কোন মন্ত্রণালয় থেকে হতে পারে। তামাক কোম্পানি শিল্প মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের কাছে দায়বদ্ধ, তারাও তামাক চাষে কোম্পানির প্রলুবদ্ধকরণ বন্ধে পদক্ষেপ নিতে পারেন।

প্রশ্ন: গত ১০ বছরের হিসাবে তামাক চাষ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে আর কি করা দরকার?

ডা. মোস্তফা জামান: প্রথম তামাকের পাতার চাহিদা কমাতে হবে। চাহিদা কমানোর জন্য যথেষ্ট কাজ হচ্ছে না। তামাক পাতা বিদেশে রপ্তানি হোক, এটা আমরা চাইতে পারি না। আমাদের জমির পরিমান কম, জনসংখ্যা বেশি। আমাদের খাদ্য আমদানী করতে হয়, সেটা দেখতে হবে। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম, কত হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি করতে হবে। যে দেশকে চাল আমদানি করতে হয়, চাল যাদের প্রধান খাবার সেই দেশের জমি কেন তামাক চাষের জন্য ব্যবহার হবে? তামাক চাষ কমাতে হলে কৃষকদের নিয়ে কাজ করা দরকার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যদি কৃষকদের তামাক চাষ থেকে নিবৃত্ত করতে কাজ করেন, তবেই তামাক চাষ কমানো সম্ভব।

যেখানে তামাক চাষ বেশি, সেসব এলাকায় যে টাস্কফোর্স কমিটি যদি চাষীদেরকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন তাহলে এটা কমে আসবে। অন্য যে শস্যগুলো আছে সেগুলোতে যদি প্রণোদনা দেয় হয়, এবং তাদের উৎপাদিত শস্য ইন্সুরেন্সের আওতায় আনা গেলেও তামাক চাষ কমানো যাবে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় তামাক নিয়ন্ত্রণ যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এ অন্তর্ভুক্তির বাস্তবায়ন কি প্রক্রিয়ায় হবে বা হচ্ছে কি না, তার দিক নির্দেশনা নাই। এটা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়?

ডা. মোস্তফা জামান: বিভিন্ন অধিদপ্তরে লাইন ডিরেক্টরের অফিসগুলোতে এটা অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) তৈরী করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটা “হেলথ অপারেশনাল প্ল্যান” হয়েছে। এর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার মাধ্যমে৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যেতে পারে।

প্রশ্ন: তামাক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা কিভাবে হবে তার নির্দেশনা এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩-এ আছে। বাংলাদেশ এফসিটিসির এ আর্টিকেল বাস্তবায়নে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি। কোন গাইডলাইন বা কোড অব কন্ডাক্ট নেই। এ নিয়ে কি বলবেন?

ডা. মোস্তফা জামান: এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩ এর বাস্তবায়ন খুবই দরকার। না হলে কে সরকার, কে ইন্ডাষ্ট্রি এটা অনেক সময় বোঝা মুশকিল হয়ে যায় যেমন: ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির যে পরিচালনা বোর্ড আছে, সেখানে সরকারের প্রতিনিধি বেশি। ৯ জনের মধ্যে ৬ জন। তাহলে এটা কি সরকারী প্রতিষ্ঠান না বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এটা বোঝা কঠিন হয়ে যায়। সরকারের প্রতিনিধির আধিক্য থাকার কারণে বিএটি’র পক্ষে সরকারকে প্রভাবিত করা সহজ হয়ে যায়।

প্রশ্ন: বিএটির পরিচালনা পর্ষদে ৯ জনের মধ্যে সরকারের ৬ জন থাকলেও সরকার বিএটি থেকে খুব কম সুবিধা পায়। বছরে ১৫০ কোটির মত। সরকারী প্রতিষ্ঠানের যে শেয়ার ১১% এর মত, মুনাফা কিন্তু বেশি না।

ডা. মোস্তফা জামান: যেহেতু সরকারের লাভ খুব বেশি না, সেজন্য ৬জন পরিচালক ওখানে কেন বসিয়ে রাখতে হবে?

প্রশ্ন: এনবিআর বা অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠান যেমন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর যারা কোন না কোনভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট তাদের গাইডলাইন বা কোড অব কন্ডাক্ট দরকার কি না?

ডা. মোস্তফা জামান: সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্যই গাইডলাইন থাকা দরকার। গাইডলাইনের একটা টেমপ্লেট আছে, কি ধরনের হবে। এ আলোচনা শুরু করতে হবে। তামাক কোম্পানির সাথে সরকারকে সাবধানতার সাথে কিছু নীতি মেনে আলোচনা করতে হবে, তা বুঝতে হবে।
প্রশ্ন: শিশুদের স্কুল, যেমন প্রাইমারী স্কুলের সামনে সিগারেটের দোকান। বাচ্চারা অল্পবয়সে সিগারেটের নাম ও সিগারেট দেখে এবং একধরনের কনসেপ্ট তৈরী হয়, এটা খারাপ কিছু না। সিগারেটের প্রমোশন হচ্ছে। সিগারেটকে সহজলভ্য করে তুলছে। পয়েন্ট অব সেলগুলো আমরা কিভাবে কন্ট্রোল করতে পারি?

ডা. মোস্তফা জামান: এটা খুবই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাচ্চারা বাবা-মা থেকে দুরে থাকে সেই সময়ে তারা এটা ধূমপান শুরু করে, এডভেঞ্চারের জন্য, বা বন্ধু-বান্ধবের চাপে পড়ে। এজন্য উন্নত দেশগুলোতে স্কুলের আশেপাশে নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে তামাক বিক্রয়কেন্দ্র থাকে না।

ভারতে যখন এধরনের আইন করার চেষ্টা করা হয়েছিলো যে স্কুলের সেন্টার থেকে একটা নির্দিষ্ট দুরত্বে তামাক বিক্রির দোকান থাকবে না তখন তামাক কোম্পানিগুলো প্রচন্ড বাধা সৃষ্টি করেছিলো। তবু ভারত স্কুলের সামনে তামাক বিক্রয়কেন্দ্র নিষিদ্ধ করেছে। এ দেশেও এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যেন স্কুলের গেইট, বা উল্টো পাশে যেন সিগারেট বা তামাকজাত পন্য বিক্রয় করতে না পারেন। স্থানীয় সরকার তথা সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ এটা করতে পারেন। আমি অনেকদিন থেকে বলে আসছি, তামাকপণ্য বিক্রি লাইসেন্সের আওতায় আনতে হবে। অদূর ভবিষ্যতে দেখতে চাই, এক শলাকা করে কোন তামাকপণ্য বিক্রি হবে না। আস্ত প্যাকেট বিক্রয় করতে হবে এবং প্যাকেটের সাইজ ২০ শলাকার নিচে হবে না। যদি এই দুটো বিষয় মানা যায়, তাহলে অনেক কিছুতে পরিবর্তন আসবে। ভবিষ্যতে আইনের যে সংশোধন হবে, এই দুটো বিষয় যেন থাকে; ‘লাইসেন্স’ ও ‘শলাকা ভিত্তিক সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ’। এ দুটো বিষয় যদি পালন করা হয় ভবিষ্যতে তাহলে বাচ্চারা আর নতুন করে সিগারেট ধরবে না।

প্রশ্ন: আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছি, এসডিজির স্বাস্থ্য বিষয়ক লক্ষ্যমাত্রায় এফসিটিসির বাস্তবায়ন ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ দুটো আলাদা টার্গেট আছে। প্রধানমন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন যে ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করবেন। সেজন্য আামদের কি করা দরকার? এসব অর্জন করতে গেলে কি করা দরকার?

ডা. মোস্তফা জামান: আসলে দুটো টার্গেট কিন্ত খুব আলাদা না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল এনসিডি মনিটরিং ফ্রেমওয়ার্ক-এ ২০২৫ সনের মধ্যে অন্তত ২৫ ভাগ তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। আর এসডিজিতে আছে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ ভাগ কমাতে হবে।

আমি এ বিষয়ে খুব আশাবাদী। একসময় অনেকেই বলতো তামাক নিয়ন্ত্রণে কোন কাজ হয় না। তোমরা এত কিছু করো, কই ধূমপান তো হচ্ছে। কিন্তু যেগুলো হয় সেগুলো নিয়ে মানুষ খুব কম কথা বলে। বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণের অগ্রগতি অনেক বড় এবং এই বড়টাকে আরো বড় করতে আইনটার আরেকটা সংশোধন দরকার। সচিত্র সতর্কবাণী ৮০/৯০% করতে হবে। যদি প্লেইন প্যাকেজিংয়ে আসতে পারি, তাহলে খুবই ভালো। আর তামাকের কর খুব জোরালোভাবে বাড়াতে হবে। কেউ কেউ বলে তামাক নিয়ন্ত্রণ হয়ে গেলে টাকা পাবো না। এটা খোড়া যুক্তি। মানুষকে হত্যা করে আপনি টাকা নিতে হলে আফিম, গাঁজার চাষ অনুমোদন দেয়া হবে? টাকাটা এখানে ইস্যু না কারন, ওগুলো মানুষের ক্ষতি করে।

আসলে আলাদা করে কিছু নয়, আমরা এমপাওয়ার-এর যে কথাগুলো বললাম, সেগুলো সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কার কি কাজ এটা পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। তাহলেই এটা মনিটর করা সম্ভব। আমি মনে করি, সিগারেটের বা তামাকের এন্ড গেইম, শতকরা ৫ ভাগের কম ২০৪০ সনের আগেই অর্জন করা সম্ভব। এখন যে হারে চলছে, এখানে ওখানে পুশ দিলে বিশেষ করে তামাকের কর বৃদ্ধি বা তামাক চাষ এদুটো জায়গায় যদি হিট করা যায় তাহলে ২০৪০ সনের আগেই এটি অর্জন করা সম্ভব। তামাক বিক্রির জন্য ‘লাইসেন্স’ ও শলাকাভিত্তিক সিগারেট বিক্রি বন্ধ করতে পারলেও আমি আশা করি ২০৩৫ সালের মধ্যেই সে জায়গায় চলে আসবো।

 

অধ্যাপক ড. মোস্তফা জামান বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশনা ও গবেষণা এডভাইজর হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ২০০৩ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বাংলাদেশ কার্যালয়ে যোগ দেন এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে নেতৃত্ব প্রদান করেন। তাঁর সময়কালে তামাক নিয়ন্ত্রণ ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ ও বিধিমালা ২০০৬ জারি, ২০০৭ সালে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল প্রতিষ্ঠা ও সক্রিয়করণ, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী পাসসহ বিভিনড়ব ক্ষেত্রে তিনি প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। এছাড়া ইমপ্যাক্ট অব টোব্যাকো রিলেটেড ইলনেস শিরোনামের বহুল আলোচিত গবেষণার পাশাপাশি গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে, গ্লোবাল ইয়ু টোব্যাকো সার্ভেসহ বিভিনড়ব জাতীয় পর্যায়ের গবেষণা কাজেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষণা সমৃদ্ধ করতে তাঁর ভূমিকা অগ্রগণ্য।

 ২০১৭ সালে ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এমপাওয়ার নীতি বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি বিষয়ক গবেষণার অংশ হিসাবে তাঁর সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়েছে। এটি অনুলিখন করেছেন মো. আবু রায়হান।