তামাক নিয়ন্ত্রণে ‘কোম্পানির হস্তক্ষেপ’ সময়ের বড় প্রতিবন্ধকতা

সৈয়দা অনন্যা রহমান | বর্তমানে বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে অনেক অগ্রগতি দেখানো হলেও ২০১৭ সালের গ্যাটস এর ডাটা অনুসারে তামাক ব্যবহারকারীর হার ৩৫.৩%। ২০১৮ সালে তামাকজনিত রোগে অকাল মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজার জনের। বাংলাদেশ প্রতিবছর তামাকজনিত রোগ ও অকাল মৃত্যুর কারণে ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা বা ৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমান অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ১৯৮৮ সাল হতে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস সারা পৃথিবীতে পালিত হয়ে আসছে। আর্ন্তজাতিকভাবে পালিত হলেও বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে জাতীয়ভাবে কোন নিদিষ্ট দিবস পালন করা হয় না। ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটভুক্ত সংগঠনগুলো যথাযথ মর্যাদার সাথে ৯ অক্টোবর জাতীয় তামাকমুক্ত দিবস পালন করে আসছে। এবছর জাতীয় তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে “ জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সকল নীতিতে তামাক কোম্পানীর হস্তক্ষেপ প্রতিহত করুন” 
 
বিশ্বব্যাপী সব ধরনের তামাকের ব্যবহার সীমিত করার লক্ষ্যে প্রণীত হয় আন্তর্জাতিক চুক্তি Framework Convention onTobacco Control- FCTC এর আর্টিক্যাল ৫.৩ তে জনস্বার্থে প্রণীত নীতিসমুহকে তামাক কোম্পানীর প্রভাব থেকে সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব প্রদাণ করে এটি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট নিদের্শনা প্রদান করা হয়েছে। উক্ত নির্দেশনার আলোকে সরকারের সব সেক্টরকে নিয়ে সমন্বিত পন্থা নির্ধারন ও সহায়ক নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রই ইতোমধ্যেই এফসিটির আলোকে তামাক কোম্পানীর প্রভাব থেকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তাদের রাস্ট্রীয় আইনে উক্ত বিষয়টি সম্পৃক্ত করেছে। 
 
উগান্ডা, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ব্রাজিল, পানামা, ইউরোপিয়ার ইউনিয়ন, অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ আরো কিছু রাষ্ট্র এফসিটিসির আর্টিক্যাল ৫.৩ অনুসারে নিজেদের দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ও নীতি সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নেপালে তামাক কোম্পানীর কাছ থেকে সরকারী সংস্থা, কর্মকর্তাদের সকল ধরনের সহায়তা, উপহার (আর্থিক বা অন্যান্য) সহায়তাসহ লেখাপড়ার আমন্ত্রণ বা প্রস্তাবনা গ্রহণ অস্বীকার করার আইনী বিধান রয়েছে। মিয়ানমারে স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, স্থায়ী সচিবের অনুমতি ছাড়া তামাক কোম্পানির প্রতিনিধির সাথে মন্ত্রণালয়ের কর্মী ও কর্মকর্তাদের যেকোনো ধরনের মিটিংয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কোনো ধরনের মিটিং হলেও তার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে হবে বলেও জানানো হয়েছে। 
 
জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে আইন, বিধি, সারচার্জ ব্যবস্থাপনা নীতি, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন নির্দেশিকা প্রণয়ণ করা হলেও এগুলোর বাস্তবায়নের গতি খুব ধীর। ধীর গতির অন্যতম প্রধান কারণ তামাক কোম্পানীগুলোর আইনে প্রতি অশ্রদ্ধা এবং অনৈতিক হস্তক্ষেপ। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে ধূমপায়ীদের কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হবার ঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় ১৪ গুণ বেশী। এমন অবস্থার মধ্যেও তামাক কোম্পানীগুলো নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়িয়ে তামাকের ব্যবসা অব্যহত রেখেছে। তামাকের কর বৃদ্ধি, তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ, সহায়ক নীতি প্রণয়ন, আইন বাস্তবায়ন প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে তামাক কোম্পানীর প্রভাব। 
 
ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট (২০১৮-২০২০ সালের মে মাস পর্যন্ত) পরিচালিত তামাক কোম্পানীর হস্তক্ষেপ বিষয়ক এক গবেষনায় দেখা গেছে, তামাক কোম্পানীগুলো এসময়কালে সবচেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তার করেছে নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ৪১.৯%। মন্ত্রণালয় ও সরকারী বিভিন্ন বিভাগে হস্তক্ষেপের তথ্য পর্যালোচনা করে পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশী প্রভাব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে ১৮.২%। তারপরই রয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় প্রভৃতি। 
 
তামাক চাষ কার জন্য অর্থকরী ফসল? এটি শুধু কোম্পানীর জন্যই অর্থকরী, কৃষকের জন্য কোনদিনও নয়। কোম্পানীগুলোর আগ্রাসী ভূমিকা এবং সরকারের তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে জোরালো কোন পদক্ষেপ না থাকায় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে তামাক চাষ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্পৃক্তদের তামাক চাষ থেকে বিরত রাখার জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বা অন্য কোন আইনে বাধ্যবাধতা না থাকায় তামাক কোম্পানীগুলো বিভিন্নভাবে সুযোগ নিচ্ছে। সেকারণেই এখনো কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) এর ওয়েব সাইটে প্রদত্ত ক্রপস উইং সংক্রান্ত তথ্যের শুরুতেই উল্লেখ করা রয়েছে “ ক্রপস উইং দানাদার, ডাল, তৈলবীজ, পাট, আখ, তামাক, পান, বাঁশ ইত্যাদি ফসলের উন্নয়নে কাজ করে”। 
 
এছাড়াও উদ্বেগের বিষয়, দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ২০০৫ সালে একটি আইন প্রণীত হলেও ২০১৮ সালে কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ তে তামাক কে অর্থকরী ফসল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তামাক কোম্পানীর প্রভাব ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এর অন্যতম কারণ। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রতি বছর সিগারেট প্রস্তুতকারক, তামাক রপ্তানীকারক, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/সংস্থা এবং কৃষক প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত কৃষি মূল্য উপদেষ্টা কমিটির মাধ্যমে তামাকের সর্বনিম্ন দাম নির্ধারন করা হয়ে থাকে। এসকল অসামঞ্জস্যতা একদিকে এসডিজি অর্জনে বাধা দিচ্ছে অন্যদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুসারে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা তৈরী করছে।
 
বাংলাদেশে নীতিগুলো সুরক্ষিত ও তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গতিশীল করতে এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ অনুসারে গাইড লাইন প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবী। সেইসাথে রাস্টের প্রণীত আইনগুলোর সাথে সাংর্ঘষিক আইনগুলো সংশোধনের পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বর্তমানে বলবৎ ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনটি সংশোধন করে আরো শক্তিশালী করাও জরুরী।

লেখক: সৈয়দা অনন্যা রহমান, জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন কর্মী, anonna@wbbtrust.org