তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা

ভূমিকা: এ উপমহাদেশে পানের ব্যবহার অনেক প্রাচীন, প্রখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার ভ্রমন কাহিনীতে পান ও সাথে নানা উপকরণ দিয়ে অপ্যায়নের কথা বর্ণনা করেছেন, তবে এ সকল উপকরনে মধ্যে তামাক ব্যবহার ছিল না। ভারতীয় উপমহাদেশে পূর্তগীজরা ১৬০৫ সালে তামাক চাষ শুরু করে । মাত্র কয়েক শতকের মধ্যে এ ক্ষতিকর দ্রব্য ব্যবসার পিছনে থাকা মানুষগুলো শুধু এ ব্যবসার প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে, মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টির পাশাপাশি আইন কানুনের মাঝে সুবিধা নিশ্চিত করে নেয়। তামাক নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা শুরু হয় তার অনেক পরে। এ সময়ের মধ্যে তামাক ব্যবহার ব্যাপকভাবে দেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। বিগত কয়েক দশকে তামাকের ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, পরিবেশের উপর ক্ষতিগুলোর বিষয়ে ব্যাপক গবেষণালব্ধ তথ্য প্রমান প্রকাশ হওয়ায় বাংলাদেশেও তামাক নিয়ন্ত্রণে নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ কিছুটা জোরদার হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের বিষয়টি রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও, এ দেশে জনস্বাস্থ্য বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবহেলিত। জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের নেই কোন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও অর্থায়নের ব্যবস্থা। গত ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ এশিয়ার স্পিকার সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আর এ ঘোষণার মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এক নতুন মাত্রা যোগ হয় । আন্তর্জাতিকভাবে তামাকমুক্ত বলতে কোন দেশে তামাক ব্যবহার ৫%-এ নেমে আসাকে বুঝায়। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫% তামাক ব্যবহার করে। অর্থাৎ ২০৪০ সালের পূর্বে বাংলাদেশে প্রায় ৩০% তামাক ব্যবহার হ্রাস করতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশই তরুণ। অর্থাৎ- ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা হলো চার কোটি ৭৬ লাখ। ২০৬১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা পাঁচ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। ২০১১ সালে যে সংখ্যাটি ছিল ১ কোটি ১২ লাখ, তা ২০৬১ সালে আনুমানিক ৫ কোটি ৫৭ লাখ হবে। বর্তমান যুবদের অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সচেতন করতে পারলে আগামীতে দিনের প্রবীণদের মাঝে এ রোগ কমে আসবে। অপর দিকে তামাক কোম্পানিগুলোর লক্ষ্যও এই তরুণরা, কারণ আজকের তরুণদের তামাক ব্যবহারে অভ্যস্ত করতে পারলে তারা দীর্ঘদিনের গ্রাহক পাবে। এ অবস্থায় সরকার ও তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠনগুলোকে সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ জাতীয় পরিকল্পনার গ্রহণের লক্ষ্যে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দূরবর্তী এবং বিস্তৃতি হওয়া জরুরি। পরিকল্পনার ক্ষেত্রে জনসংখ্যা, শিক্ষা, ভৌগলিক অবস্থান, মানুষের আচরণ, জীবনযাত্রা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে কর্মসূচী প্রণয়ন করতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, কোম্পানিগুলো। আইন থাকার পরও তামাক কোম্পানিগুলো নানা কৌশলে তামাকের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য কাজ করছে। এ অবস্থায় পরিকল্পনা সুচিন্তিত না হলে তামাক নিয়ন্ত্রণের মতো জটিল বিষয়ে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিগত পদক্ষেপ: বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রথম পদক্ষেপ ১৮৯০ সালের রেলওয়ে আইনের মাধ্যমে সুচিত হয়। এ আইনে সহযাত্রীদের অনুমতি ব্যতীত রেলওয়ে কম্পর্টমেন্ট-এ ধূমপান শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯১৫ সালে শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ শিক্ষক ম্যানুয়েলে ধূমপান বিরোধী তথ্যাদি সংযুক্ত করেন। ১৯১৯ সালে কিশোরদের নিকট সিগারেট বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয় । তবে এ আইনের প্রয়োগ খুবই দুর্বল ছিল। ১৯৫২ পরবর্তীতে সিনেমা হলে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয় । ১৯৬৮ সালে টোব্যাকো প্রমোশন বোর্ড স্থাপন করা হয়েছিল, যদিও পরে বা বাতিল করা হয়। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে টেন্ডু বিড়ি উৎপাদন, বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয় । ১৯৭৬ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশে ধূমপান নিষেধ সম্বলিত নোটিশ প্রর্দশিত এলাকায় ধূমপান করলে জরিমানার বিধান করা হয় । পরবর্তীতে অন্যান্য মেট্রোপলিটন পুলিশ আইনে বিধানটি যুক্ত করা হয়।

১৯৮৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় নিপসম আয়োজিত একটি সেমিনারের তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রথম বিস্তারিত সুপারিশ পাওয়া যায় । পরবর্তী সময়ে জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নুরুল ইসলাম তাঁর তামাক বিরোধী কার্যক্রমে বিজ্ঞাপন বন্ধের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তুলে নিয়ে এসেছেন । ১৯৮৮ সালে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর প্রদানের জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়। প্রায় এই সময় হতে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে নির্বাহী সিদ্ধান্তে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ হয়। ১৯৯০ সালে তামাকজাত সামগ্রী বিপণন (নিয়ন্ত্রণ) সংশোধন অধ্যাদেশ প্রণীত জারি হয় , যাতে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপনের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হলেও আইনটি আলোর মূখ দেখেনি।

আইনের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের স্ব-উদ্যোগে কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তার মধ্যে ১৯৮৭ সালে বিটিভি এবং বাংলাদেশ বেতারে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার, প্রর্দশন নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৮৮ সালের ১৬ আগষ্টে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন, ১৯৮৮ সালের ০৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি ভবন, ১৯৮৯ সালে ০৭ মেতে বাংলাদেশ বিমানের অভ্যন্তরীন ফ্লাইট, ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী অফিস, ২০০০ সালে ৩১ মেতে সচিবালয়ে ধূমপানমুক্ত করা হয় ।

১৯৯৯ সালের দিকে বেসরকারীভাবে দৈনিক ভোরের কাগজ স্ব-উদ্যোগে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ছাপানো হতে বিরত থাকার ঘোষণা করে । ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নুরুল ইসলাম সিগারেটের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধের দাবিতে মহামান্য হাইকোর্টে মামলা করেন , যা তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধের দাবিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে ভয়েজ অব ডিসকভারীর নাম এক প্রচারণা কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটভুক্ত সংগঠনগুলো একটি রীট করে। এই রীটের প্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট বিএটি-র ভয়েজ অব ডিসকভারীর কার্যক্রম অবৈধ ঘোষণা করে এবং সরকারকে একটি আইন প্রণয়নের নির্দেশনা প্রদান করে ।

১৯৯৯ সালে সরকার বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট-এর প্রতিনিধিসহ বেসরকারী সংগঠনেরর প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে একটি পূণাঙ্গ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের জন্য কমিটি গঠন করে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট ও ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট বাংলাদেশ পূণাঙ্গ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নে করণীয় সংক্রান্ত একটি প্রকাশনা প্রকাশ করে। এই প্রকাশনাটি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের বিষয়ে জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।

২০০৩ সালে ইম্পেরিয়াল টোবাকো কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা বাংলাদেশে তামাকের বিজ্ঞাপন বন্ধে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। ইম্পেরিয়াল টোবাকো কোম্পানী বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা শুরু করার লক্ষ্যে পত্র-পত্রিকা এবং টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করে। বিজ্ঞাপনের বিষয় ছিল ঞঐঅগঊঝ সিগারেট খাওয়ার প্রেক্ষিতে লটারিতে পাওয়া যাবে ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ। এ ধরনের প্রলোভন দিয়ে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে। লটারির মাধ্যমে এ ধরনের প্রলোভন বাংলাদেশ দন্ডবিধির ২৯৪বি ধারা লঙ্ঘন। বাংলাদেশে তামাক বিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে ইম্পেরিয়াল টোবাকো কোম্পানির ঞঐঅগঊঝ ব্রান্ডের প্রচারণা কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা ও রীট পিটিশন দায়ের করা হয় । উক্ত মামলায় ইম্পেরিয়াল টোব্যাকো কোম্পানির কার্যক্রমের উপর আদালত অস্থায়ী নিষেধ জারি করেন।

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫-র পরবর্তী অবস্থা: ২০০৫ সালের পূর্বে তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে যতগুলো আইন ছিল যেগুলো খন্ডিতভাবে বিভিন্ন বিষয়ের উপর ছিল, যেমন ধূমপান নিষেধ, স্বাস্থ্য সতর্কবাণী, বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ এবং কিশোরদের নিকট তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ। ২০০৫ সালে সরকার প্রথম পুর্ণাঙ্গ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের মাধ্যমে সকল বিষয়গুলোকে একসাথে সন্নিবেশিত করা হয়।

২০০৫ সালে আইনের বড় অর্জন হলো- সকল প্রচার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বিজ্ঞাপন বন্ধ, ধূমপানমুক্ত স্থানের পরিধি বৃদ্ধি এবং তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে স্পষ্ট লিখিত স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান। আইন পাশের পর তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ব্যপকভাবে হ্রাস পায়, তবে তামাক কোম্পানির পরোক্ষ বিজ্ঞাপন এবং সিএসআর কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। ২০০৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগ বিএটি’র লগো ব্যবহার করে সিএসআর কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ঢাকা জর্জ কোর্টে একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছিল। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৭ সালে জাতীয়, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এই টাস্কফোর্স তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ব্যাপক ভুমিকা রাখে। ২০০৭-০৯ সালে ব্লুমবার্গ ইনিশিয়েটিভের আওতায় এবং দি ইউনিয়নের কারিগরি সহযোগিতায় সারা দেশে টাস্কফোর্সগুলোর সভা আয়োজনে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।

২০০৫ সালে আইন বাস্তবায়নের নানা প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত হয় এবং, আইনটি পুণরায় সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে আইনটি ২০১৩ সংশোধন করা হয়। এই সংশোধনীতে ধূমপানমুক্ত স্থানের পরিধিবৃদ্ধি, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবানীসহ জরিমানার পরিমান বৃদ্ধি করা হয়। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে ১৮টি ধারা রয়েছে, এই আইনের লঙ্ঘন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারাসমূহ নিম্নরুপ;

ধারা  বিষয়  ভঙ্গকারী জরিমানা
পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান ব্যক্তি ৩০০ টাকা
বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ তামাক কোম্পানি ও ব্যবসায়ী ৩ মাসের জেল ও ১ লক্ষ টাকা জরিমানা
অটোমেটিক ভেন্ডিং মেশিন নিষিদ্ধ তামাক কোম্পানি ৩ মাসের জেল ও ১ লক্ষ টাকা জরিমানা
৬ক অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নিকট/দ্বারা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ তামাক কোম্পানি ও ব্যবসায়ী ৫০০০ টাকা
ধূমপানের এলাকা প্রতিষ্ঠানের মালিক/কর্তৃপক্ষ ৫০০ টাকা
ধূমপানমুক্ত সাইন স্থাপন প্রতিষ্ঠানের মালিক/কর্তৃপক্ষ ১০০০ টাকা
১০ সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান তামাক কোম্পানি ও ব্যবসায়ী ৬ মাসের জেল ও ২ লক্ষ টাকা জরিমানা
       

তবে, সাম্প্রতিক সময়ে তামাক কোম্পানি নিত্য নতুন প্রক্রিয়ায় আইনভঙ্গের প্রচেষ্টা এবং তামাক ব্যবহারে আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখায় এ আইন আবারও সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে সুপারিশমালা:

পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহণে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ: বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধের বিধান রয়েছে, এই বিধানের সাথে অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারও পাবলিক পরিবহনে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। কোভিডকালীন সময়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং কিছু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যত্রতত্র থুতু ফেলা রোধে পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে চর্বণযোগ্য তামাক ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। বিদ্যমান আইনের বিষয়টি যুক্ত করা হলে তা সারা দেশের জন্য কার্যকর করা সম্ভব।

ধূমপানমুক্ত স্থানের উদ্দেশ্য হচ্ছে ধূমপায়ীদের ধূমপান হতে বিরত রাখা। বিদ্যমান আইনে পাবলিক প্লেস ও পরিবহনের মালিক ইচ্ছা করলে ধূমপানের স্থান রাখতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে তামাক কোম্পানিগুলোর সহযোগিতায় রেষ্টুরেন্টে ব্যাপকভাবে ধূমপানের স্থান সৃষ্টি করা হয়েছে, যা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের উদ্দেশ্যকে ব্যহত করছে। পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানের স্থানের ফলে অধূমপায়ীরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধূমপানের স্থানের বিধান বিলুপ্ত করা হচ্ছে, বাংলাদেশের আইনেরও বিধানটির বিলুপ্ত করা প্রয়োজন। বিদ্যমান আইনে ধূমপানমুক্ত সাইন স্থাপন না করলে ১০০০ টাকা এবং ধূমপানমুক্ত স্থানে ধূমপান করলে ৩০০ টাকার জরিমানার বিধান করা হয়েছে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে জরিমানার পরিমান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ: বিদ্যমান আইনে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তথাপিও তামাক কোম্পানিগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের কাযক্রম পরিচালনা করেছে। এছাড়া বিক্রয় স্থানে তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক প্রর্দশনের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। কোম্পানি নাম, রং, লগো ব্যবহার করে সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনা নিষিদ্ধ করা হলেও আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে প্রচারণঅ চালাচ্ছে। এ সকল কার্যক্রমগুলো বন্ধে আইন সংশোধনের মাধ্যমে সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন। পাশাপাশি অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিবেচনায় তামাক কোম্পনির জরিমানাও বৃদ্ধি করা উচিত।

ই-সিগারেট/HTP/ END: ই-সিগারেট কিশোরদের তামাকে আকৃষ্ট করতে এক নতুন অস্ত্র। বাংলাদেশে এখনো মাত্র ০.২ % মানুষ ই-সিগারেট ব্যবহার করে। এই উপকরণ ব্যবহার বৃদ্ধির আগে এখনই নিষিদ্ধ করা জরুরি। ভারতসহ বিশে^র ৪২ টি দেশে ই-সিগারেট এবং HTP নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ৫৬টি দেশ ই-সিগারেট ক্রয়-বিক্রয়ের উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। আইন সংশোধনের মাধ্যমে ই-সিগারেট, ভেপিং আমদানি, উৎপাদন, ব্যবহার, বিতরন নিষিদ্ধ করা জরুরি।

তামাক বিক্রয়ের লাইসেসিং: বাংলাদেশে যত্রতত্র তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করা হয়। ছোট-বড় এ সকল বিক্রিতাদের নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশে পাশে এ ধরনের বিক্রয় কেন্দ্র বেশি পরিলক্ষিত হয়। অনেক দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে তামাক বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত তামাক বিক্রয়ের লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা। এ পদক্ষেপ অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নিকট তামাক বিক্রয় বন্ধ করার পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবে।

তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের ৯০% এলাকা ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদান: মোড়কে ছবিসহ সতর্কবানী যুবকদের তামাক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করে এবং এটি বিনামুল্যে তামাক বিরোধী প্রচারণার একটি কৌশল। বিদ্যমান আইন অনুসারে সরকার তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের সতর্কবাণী ৯০% এ উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। দক্ষিন এশিয়ার অনেক দেশই ইতিমধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে বড় ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান করেছে। মোড়কের গায়ে উৎপাদনের তারিখ না থাকায় সতর্কবানী বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

তামাকের স্ট্যান্ডার্ড মোড়ক প্রর্বতন ও খুচরা বিক্রি বন্ধ: বাংলাদেশে অধিকাংশ ব্যক্তিই খুচরা সিগারেট ক্রয় করে ফলে সরকার রাজস্ব প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হয় এবং ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবানী প্রদানের উদ্দেশ্য কাজে আসে না। সরকারের উচিত দ্রুত খুচরা সিগারেট বিক্রয় বন্ধ করা। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের কৌটা ও মোড়কের কারণে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবানী কাজে আসছে না। এমতাবস্থায় , দেশে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য কৌটা ও মোড়কের সাইজ নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন।

তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিকে সুরক্ষায় নীতি প্রণয়ন: তামাক কোম্পানিগুলো তাদের নিজস্ব ডকুমেন্টে স্বীকার করেছে যে, তারা নানাভাবে সরকারের নীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিতে কোম্পানির প্রভাব বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি এফসিটিসি-র আর্টিকেল ৫.৩তে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ চুক্তির পক্ষভুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিতে কোম্পানিগুলোর অনৈতিক প্রভাব নিয়ন্ত্রণে দ্রুত একটি গাইডলাইন প্রণয়ন প্রয়োজন। এ গাইডলাইন জনপ্রতিনিধি এবং জনসেবকদের তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি সুরক্ষায় দিক নির্দেশনা প্রদান করবে। আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়নের বিধানটি যুক্ত করা প্রয়োজন।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রয়োগ: বিদ্যমান আইনের নাগরিক বা সংক্ষুদ্ধ ব্যত্তির সরাসরি মামলা করার ক্ষমতা না থাকায়, কোম্পানিগুলো নিয়মিত আইনভঙ্গ করলেও কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া ধূমপানমুক্ত স্থানের বিধান লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ব্যতীত অন্যান্য কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জরিমানা করার ক্ষমতা না থাকায় আইনের বাস্তবায়ন আশানুরুপ হচ্ছে না। এমতবস্থায় আইনের কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ক্ষমতা এবং অপরাধ বিচারার্থ গ্রহণ এবং জামিনযোগ্য সংক্রান্ত বিধানের সংশোধন জরুরি। এ বিধানের ক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন আইন এবং নিরাপদ খাদ্য আইনের প্রয়োগের বিধান সমূহ অনুসরণ করা যেতে পারে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনের পাশাপাশি নিম্নোক্ত বিষয়গুলোতে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি:

জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী গ্রহণ: বিগত ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে সরকার তামাকজাত দ্রব্যের উপর ১% স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আরোপ করে। ২০১৭ সালে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জের অর্থ ব্যয়ের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০১৭ প্রণয়ন করা হয়। এ নীতিমালা অনুসারে একটি জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী গ্রহণ করে তামাক নিয়ন্ত্রণে এই অর্থ ব্যয়ের নির্দেশনা রয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর আওতায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদের কর্মসূচী গ্রহণ করা জরুরি।

খসড়া জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি চুড়ান্ত করা: বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আইন থাকলেও, এখনো কোন নীতি নেই। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি খসড়া জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়নের কাজ করছে। এ নীতিটি দ্রুত চুড়ান্ত করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ কাজ করতে এই নীতিটি দিকনির্দেশনা দিবে।

খসড়া জাতীয় তামাক চাষ নীতি চুড়ান্ত করা: তামাক চাষকে অর্থকরী ফসল হিসেবে আজও পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয় এবং কিছু কিছু মানুষ বিশ^াসও করে। তামাক চাষ লাভ হলে ১৬০৫ হতে আজ ২০২১ পর্যন্ত এ দেশে ধনীদের তালিকায় তামাক চাষীই থাকত। বাংলাদেশে রংপুরে দীর্ঘদিন তামাক চাষ হলেও এ অঞ্চলে মঙ্গা ও দারিদ্র একটি বড় সমস্যা। বিগত সময়ে সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে এ অঞ্চলের অর্থনীতি কিছুটা গতিশীল হয়েছে, তবে তা কোনভাবেই তামাক চাষের জন্য নয়।

বাংলাদেশে তামাক চাষ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে খাদ্য উৎপাদনযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে। এছাড়া তামাক পাতা শুকানোর জন্য কাঠ এবং অন্যান্য উপকরণ পোড়ানোর প্রেক্ষিতে বনভুমি উজারের পাশাপাশি পরিবেশও ধ্বংশ হচ্ছে। দেশের খাদ্য উৎপাদনযোগ্য জমি রক্ষায় তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে প্রণীত খসড়া নীতিমালা চুড়ান্ত এবং বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা প্রদান করেছে।

তামাক কোম্পানির হতে সরকারের শেয়ার প্রত্যাহার: তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের ইতিবাচক পদক্ষেপ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এমতবস্থায় বিএটিতে সরকারের শেয়ার তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। দ্রুততার সাথে তামাক কোম্পানি হতে সরকারের শেয়ার প্রত্যাহারে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধিতে নীতিমালা প্রণয়ন: তামাক ব্যবহার কমিয়ে আনতে কর বৃদ্ধি একটি কার্যকর উপায়। প্রতিবছর সকল পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য সে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের তামাক, জটিল মূল্যস্তর এবং কর কাঠামোর কারণে তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি করা হলেও তা ব্যবহারকারীদের উপর প্রভাব ফেলে না। কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাক ব্যবহার কমিয়ে আনতে দেশে একটি জাতীয় কর নীতি প্রণয়ন করা জরুরি।

উপসংহার: টেকসই উন্নয়নের জন্য তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। তামাকের মতো স্বাস্থ্যহানীকর দ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ সর্বোপরি রাষ্ট্রের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণে কর বৃদ্ধি এবং আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা একটি জরুরী বিষয়। আশার কথা সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণের সদিচ্ছা ও বিভিন্ন পদক্ষেপ, দীর্ঘদিন তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যরত বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা এবং গণমাধ্যমের প্রচেষ্টায় সাধারণ জনগণ এবং নীতি নির্ধারকদের মধ্যে সচেতনতার একটি জায়গা তৈরী হয়েছে। আমরা আশা করি ২০৪১ সালে মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করতে পারব।

 

লেখক পরিচিতি:

১) **সৈয়দ মাহবুবুল আলম, কারিগরি পরামর্শক, দি ইউনিয়ন
২) **এ কে এম মাকসুদ, নির্বাহী পরিচালক, গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি