তামাক পণ্যের ওপর করারোপ যেমন হওয়া উচিত

বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তামাক ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে একটি। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭ অনুসারে, দেশের প্রাপ্তবয়স্কদের এক-তৃতীয়াংশ তামাক ব্যবহার করে। তামাক জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কিছু তো নয়ই, বরং এর বহুল ব্যবহার জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি-উভয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে দেশে তামাকজনিত রোগের কারণে ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, যা ওই বছরের মোট মৃত্যুর ১৩.৫ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র প্রায় ১.৪ শতাংশ ছিল।

তামাক চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, তামাক পণ্য উৎপাদন, কৃষি জমির উর্বরতা হ্রাস, বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ার পরিবেশগত ক্ষতি ইত্যাদি হিসাব করা হলে এই ক্ষতি আরও বহুগুণ হবে। তামাক খাতে ব্যয় হওয়া পুরো টাকাই অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। একজন ব্যক্তি দিনে ১০ টাকা সিগারেটের পেছেনে ব্যয় করলে পুরোটাই তিনি নিজের ক্ষতিতে ব্যয় করলেন। দেশের অর্থনীতি থেকেই ১০ টাকা নষ্ট হয়ে গেল। এভাবে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে; যা বরং অন্য কোনো উৎপাদনশীল খাতে কাজে লাগানো যেত। আর এভাবে যে টাকা অপচয় হচ্ছে, তারই একটি অংশ সরকার রাজস্ব হিসেবে পাচ্ছে। এই দিক থেকে দেখলে, তামাক খাতের রাজস্বও সেই অপচয়ের বেঁচে যাওয়া অংশ।

বর্তমান করোনা মহামারিতে তামাক ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের অন্যতম কারণ তামাক ব্যবহার। এটি শ্বাসজনিত রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি করে। করোনাভাইরাসও শ্বাসযন্ত্রেই আক্রমণ করে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন গবেষণা পর্যালোচনা করে জানিয়েছেন, অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীরা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে, তাদের ক্ষেত্রে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। গবেষণাগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, ধূমপায়ীদের গুরুতর রোগ এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই করোনা থেকে নিরাপদ থাকতে তামাক ব্যবহার বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু, ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে তামাকের ব্যবহার কমানোর মতো কর আরোপ করা হয়নি, যা সত্যিই হতাশাজনক। নিম্নস্তরের সিগারেট, বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যের দাম সামান্য বৃদ্ধির প্রস্তাব থাকলেও সম্পূরক শুল্ক খুবই স্বল্প পরিমাণে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এই যৎসামান্য মূল্য ও কর বৃদ্ধি তামাক ব্যবহার হ্রাস ও রাজস্ব আয়ে তেমন একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। তামাক কর বাড়ানো এ জন্যই গুরুত্বপূর্ণ যে এর সঙ্গে জনস্বাস্থ্য রক্ষা এবং সরকারের আয় বাড়ানোর বিষয়টি জড়িত।

তামাকদ্রব্যে কর বাড়ালে দামও বাড়ে, যা তরুণ ও দরিদ্রদের মধ্যে তামাকের ব্যবহার হ্রাস করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। একই সঙ্গে, তামাক কর স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন খাতের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের একটি উৎস হতে পারে। তাছাড়া তামাক ব্যবহার করোনাকালীন চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। কারণ, তামাক ব্যবহারকারীদের অন্যদের তুলনায় আইসিইউ বেশি দরকার পড়ে। সেদিক থেকেও স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থার অতিরিক্ত চাপ কমাতে তামাক খাত থেকে আরও বেশি অর্থ আদায় করা জরুরি। এ জন্য তামাকজাত দ্রব্যের ওপর ৩ শতাংশ কোভিড সারচার্জ আরোপ করার বিষয়টিতে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা দরকার। কয়েক

বছর ধরে সরকার সব তামকপণ্যের ওপর ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আদায় করছে। এখন সময় এসেছে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে অন্ততপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করা। ফলে সরকার প্রায় ৩০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে পারবে, যা স্বাস্থ্য খাতকে আরও শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখতে পারবে।

বাংলাদেশে তামাক কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল। এখানে তামাক দ্রব্যের ওপর কর নির্ধারণ করা হয় বিভিন্ন স্তরভিত্তিক বিক্রয়মূল্যের ওপর, যেখানে করভিত্তি খুবই কম এবং বিভিন্ন তামাক দ্রব্যের মূল্য এবং করের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। এই বিভিন্ন মূল্যস্তরভিত্তিক কর কাঠামোর কারণে, কোনো এক স্তরের সিগারেটের দাম বাড়লেও ব্যবহারকারীরা সহজেই নিমস্তরের সিগারেটে চলে যেতে পারে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সিগারেটের মোট বাজারের ৬৭% ছিল নিম্নস্তরের দখলে; আর মধ্যম স্তরের অংশীদারত্ব ছিল মাত্র ১৪%। এ বিষয়টি রাজস্ব আয় থেকেও বোঝা যায়, ওই অর্থবছরের সিগারেট থেকে মোট রাজস্বের ৪৪ শতাংশই এসেছে নিম্নস্তর থেকে এবং ১৭ শতাংশ মধ্যম স্তর থেকে। বাজারে নি¤œস্তরের সিগারেটের আধিক্য থাকায় সরকারের রাজস্ব আয় কমে যায়। কারণ, বিক্রয়মূল্য কম হওয়ায় নিমস্তরের সিগারেট থেকে রাজস্ব কম আসে।

এই সমস্যা সমাধানে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা সিগারেটের খুচরা মূল্য বাড়ানো, বিশেষ করে নিম্নস্তরের সিগারেটের, সিগারেটের মূল্যস্তর চারটি থেকে দুটিতে নামিয়ে আনা, সব তামাকদ্রব্যের ওপর একই হারে সম্পূরক শুল্ক এবং সুনির্দিষ্ট কর আরোপের পরামর্শ দিয়েছেন। এর আলোকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে তামাক কর বিষয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। এই সুপারিশগুলোর লক্ষ্য হলো, তামাক খাত থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং তামাকের ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য রক্ষা করা। এগুলো বাস্তবায়িত হলে তামাক খাত থেকে সরকার অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পেতে পারে। পাশাপাশি, সিগারেটের দাম বাড়ানোর ফলে ব্যবহারকারীরা যেন সহজেই বিড়ি বা ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের সুযোগ না পায়, সে জন্য সেসবের ওপরও করভার বৃদ্ধি করতে হবে। যদিও প্রস্তাবিত বাজেটে সেসব সুপারিশের উল্লেখযোগ্য প্রতিফলন দেখা যায়নি।

বর্তমান মহামারি পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য রক্ষা করা এবং কোভিডের কারণে স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে অতিরিক্ত রাজস্ব আয়ের উৎস খুঁজে বের করাই সরকারের কাছে প্রাধান্য পাওয়া উচিত। সেই সঙ্গে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়া এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন তহবিল গঠন করাও প্রয়োজন। এসব সমস্যার কিছু সমাধান তামাক থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আয়ের মাধ্যমে করা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তামাকের কর বাড়ানো ও কোভিড সারচার্জ আরোপ করা হলে- ১) প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হবে; ২) প্রায় ২০ লাখ ধূমপায়ী তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হবে এবং ৩) কমপক্ষে ৬ লাখ বর্তমান ধূমপায়ীর জীবন বাঁচবে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন এবং অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যানের আওতায় তামাক সংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতবদ্ধ হয়েছে। সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তামাকের ওপর কর বাড়ানো কার্যকর উপায়। সেই সঙ্গে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নের পথেও একটি বড় পদক্ষেপ হবে এটি। তা ছাড়া তামাক করকাঠামো সংস্কার করা হলে তা স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন খাতের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগান দেবে। স্পষ্টতই এটি সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণের জন্যও লাভজনক হবে।

লেখকদ্বয়:
১) ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
২) মাহামুদ সেতু, মিডিয়া ম্যানেজার, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ।