বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক প্রভাব

সম্প্রতি বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি ‘দ্য ইকোনমিক কস্ট অফ টোবাকো ইউজ ইন বাংলাদেশঃ আ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। পুরো রিপোর্টটি পাওয়া যাবে এখানে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় পরিচালিত জাতীয় পর্যায়ের এই গবেষনাটিতে ‘আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি’র ‘গ্লোবাল ক্যান্সার কন্ট্রোল ও ইকোনমিক অ্যান্ড হেলথ পলিসি রিসার্চ ইউনিট’ এবং ক্যান্সার রিসার্চ ইউকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করেছে।

এই গবেষনায় পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, তামাক ব্যবহারের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটেছে, যা সে বছরের মোট মৃত্যুর ১৩.৫ শতাংশ। একই বছরে প্রায় ১৫ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে ভুগছিলেন এবং প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানের সংস্পর্শে আসার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তামাক ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্যখাতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিলো প্রায় ৮ হাজার ৪ শ কোটি টাকা, যার ৭৬ শতাংশের খরচ মিটিয়েছে তামাক ব্যবহারকারীর পরিবার আর ২৪ শতাংশ খরচ এসেছে জনস্বাস্থ্য খাতের বাজেট থেকে, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে সরকারী ব্যয়ের প্রায় ৯ শতাংশ।

এছাড়াও, বিভিন্ন তামাক ব্যবহারজনিত অসুস্থতা ও এর কারণে ঘটে যাওয়া অকালমৃত্যুর ফলে বার্ষিক উৎপাদনশীলতা হ্রাসের পরিমাণ ছিল প্রায় ২২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ফলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা (৩.৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), যা সে বছরের মোট জিডিপির ১.৪ শতাংশের সমান।

২০১৮ সালের দামের হিসেবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে তামাক খাতের মোট অবদান ছিলো ২২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা (in terms of household final consumption expenditure, private and public domestic investment and net export-পণ্য বিক্রি, সরকারি বেসরকারি বিনিয়োগ ও রপ্তানী অনুসারে) । যা এই খাতে অর্থনৈতিক ব্যয়, ৩০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার চেয়ে ৭ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা কম। অর্থাৎ, তামাক বাংলাদেশের ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ।

বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের বার্ষিক অর্থনৈতিক ব্যয় ২০০৪ সালের তুলনায় এখন প্রায় দ্বিগুণ (২০০৪ সালে অনুরুপ একটি গবেষণা করা হয়েছিলো)। তামাকের কারণে যে সকল ব্যয় হয়ে থাকে, তার ৮৩ শতাংশের কারণ হলো উৎপাদনশীলতা হ্রাস। আর বাকি অংশ ব্যয় হয় স্বাস্থ্যসেবা খাতে খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে। অনুমান করা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের মত দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে এই ব্যয়ের পরিমান সময়ের সাথে আরো বাড়বে এবং যেসব পরিবার তামাক ব্যবহারের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, ভবিষ্যতে তাদের উন্নয়নের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে। এই মুহূর্তে সরকারের জন্য একটি অত্যন্ত জরুরী পদক্ষেপ হলো তামাক ব্যবহারের ব্যাপকতা (টোব্যাকো এপিডেমিক) কমানোর জন্য কাজ করা যাতে দেশের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমতা বজায় রাখা সম্ভব হয়।

এই  গবেষণাতে আরো উঠে এসেছে যে, তামাকের কারণে সৃষ্ট মোট খরচের ১৪ শতাংশের জন্যই দায়ী পরোক্ষ ধূমপান। অর্থনীতির ভাষায় একে বলা হয় ‘নেগেটিভ এক্সটারনালিটি’, যেখানে ব্যক্তিবিশেষের কোন একটি কাজ বা আচরণের ফলে অন্য কেউ পরোক্ষভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ থেকে বোঝা যায়, ধূমপায়ীরা কীভাবে পরোক্ষ ধূমপানের মাধ্যমে অধূমপায়ীদের (বিশেষ করে শিশুদের) উপর কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় তামাক নিয়ন্ত্রণ সরকারের আবস্যক কাজগুলোর একটি।

মূলত রাজস্ব আয় হলো সরকারী স্বাস্থ্যসেবার সকল খরচের উৎস, যা দেশের করদাতা জনগণ (তামাক ব্যবহার করেন বা করেন না উভয়েই) বহন করে থাকেন। স্বাস্থ্যখাতে মোট সরকারী ব্যয়ের ৯ শতাংশই তামাক সম্পর্কিত রোগের পেছনে খরচ হওয়ার বিষয়টি ‘মার্কেট ফেইলিয়ার’ সর্বোপরি পরোক্ষ ধূমপানজনিত ক্সতির কারণে ‘নেগেটিভ এক্সটারনালিটি’র উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তামাকজাত দ্রব্যের ওপর উচ্চহারে করারোপের মাধ্যমে এর দাম বাড়াতে সরকারকে তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে হবে।

যদিও এই গবেষণাতে তামাকজনিত রোগের কারণে স্বাস্থ্যখাতে সরকারের প্রত্যক্ষ ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা হ্রাসের কারণে হওয়া পরোক্ষ ব্যয়ের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, তারপরও তামাক চাষের ফলে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ক্ষতির পেছনে সরকারের যে খরচ; তামাক চাষের কারণে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাওয়া ও এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা হ্রাস; ধূমপান থেকে সৃষ্ট অগ্নি-জনিত দুর্ঘটনা; তামাক চাষ, তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদন ও সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ যেখানে সেখানে ফেলার কারণে পরিবেশ দূষণ এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে আনা সম্ভব হয়নি। এগুলোর পেছনে সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ হিসাব করা হলে, তামাক খাতে ক্ষতির মোট পরিমাণ আরো অনেক বেশি হতো।

বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০০৪ সালে ডব্লিউ এইচ ও ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এ সাক্ষর করা এবং  ২০০৫ ও ২০১৩ সালে যথাক্রমে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস ও আইনের সংশোধন করার পরেও দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নীতিগত অগ্রগতি অত্যন্ত সীমিত। তামাক ব্যবহারের হার কমে আসা সত্ত্বেও, মাননীয় প্রধাণমন্ত্রীর অংগীকার অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করণের লক্ষ্য অর্জস সম্ভব নয় হলে প্রতিয়মান হচ্ছে। এই লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে হলে, ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোল এর গাইডলাইন অনুসারে আরো কঠিনভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করতে হবে, বিশেষ করে দেশের যুবসমাজ, যারা পরবর্তী সময়ে ধূমপায়ী হয়ে উঠতে পারে, তাদের নিয়ে আরো বেশি কাজ করতে হবে।

জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস (এসডিজি) এ দারিদ্র্য বিমোচন, অসংক্রামক রোগের কারণে মৃত্যুর হার এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা এবং অসুস্থতার কারণে সৃষ্ট অপুষ্টির কারণে আর্থিক ক্ষতির বিপরীতে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ নিশ্চিত করা- এর পাশাপশি তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য সরাসরি জড়িত। তামাক ব্যবহার বন্ধ করা গেলে তামাকজনিত কারণে মৃত্যু ও রোগের পরিমাণ এবং পরোক্ষ ধূমপানজনিত ক্ষতির হার ব্যাপকহারে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, একইসাথে তা ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যগুলো অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক: ড. নিগার নার্গিস, যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির সায়েন্টিফিক ডিরেক্টর।

‘দ্য ইকোনোমিক কস্ট অব টোবাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ : অ্যা হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণার ভূমিকা/এক্সিকিউটিভ সামারি থেকে অনুবাদ করেছেন, অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো এর গবেষণা সহকারী, আদিবা কারিন।