তামাক কোম্পানির প্রতারণামূলক কর্মসূচি বন্ধ হোক

তামাক জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর, একথা সর্বজনস্বীকৃত। তামাক আসক্তির কারণে বছরে পৃথিবীতে ৮০ লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়, এসব অকালমৃত্যুর ৮০ভাগ বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে ঘটছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে তামাকের বহুমাত্রিক ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইনের কঠোরতার ফলে চতুর তামাক কোম্পানিগুলো ঐ সকল দেশ হতে তামাক ব্যাবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এজন্য প্রাণঘাতী এ পণ্যের ব্যবসা প্রসারে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তামাক কোম্পানিগুলো প্রতারণামূলক কর্মসূচি সম্প্রসারিত হচ্ছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ তামাক ব্যবহারকারী ১০টি দেশের মধ্যে অন্যতম। এবং বাংলাদেশে ১ লক্ষ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তামাকের বহুমাত্রিক ক্ষতি বিবেচনায় সরকার দেশে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন পাস ও সংশোধন করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ করতে তামাক কোম্পানিগুলো নানাভাবে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য মানুষকে নানান কূটকৌশলের মাধ্যমে স্বাস্থ্যহানিকর তামাকের নেশায় ধাবিত করছে। মূলত, তামাক কোম্পানির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুনাফা অর্জন করা। তামাকজনিত রোগ ও অকালমৃত্যু তাদের বিবেচ্য বিষয় নয়!

বলা হয়ে থাকে, তরুণরা দেশের অমূল্য সম্পদ। আগামী দিনের কর্ণধার। আজকের তরূণরা আগামীর প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবি হবে। পেশা যাই হোক, তরুণরা দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করে যাবে এমন অভিপ্রায় সবার। কবি সুবীর কাস্মীর পেরেরার ‘পথ হারাবে না বাংলাদেশ’ কবিতায় বলেছেন-
-যতদিন তোমার হাতে দেশ, পথ হারাবে না বাংলাদেশ।

তরুণরা তখনই সঠিক পথে দেশ পরিচালনা করতে পারবে যখন তারা নিজেরা সঠিক পথে তাদের জীবন পরিচালনা করার মাধ্যমে নিজেদের যোগ্য নেতৃত্ব ও সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী করে তুলবে। স্বাস্থ্যই সকল সুখ ও সাফল্যের মূলমন্ত্র। জনগণের সুস্বাস্থ্য সার্বিক সাফল্য অর্জনেরও অন্যতম নিয়ামক।

‘সু-স্বাস্থ্য কিংবা অসুস্থ্যতা’ প্রসঙ্গে বিবিধ কারণ সামনে চলে আসে। যেমন, মুনাফালোভী তামাক কোম্পানিগুলোর প্রলোভনে যে হারে অনেক তরুণ ধূমপান শুরু করে, তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ধূমপানের মাধ্যমে অন্যান্য নেশায় ধাবিত হচ্ছে, তা দেশের জন্য মারাত্মক অশনিসংকেত। ফলে দিনে দিনে বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ার মত বাংলাদেশের ভবিষ্যতও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। তামাক কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তরুণদের টার্গেট করে প্রাণঘাতী তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার, বিপণন ও বাজারজাত করণ ও বিভিন্ন প্রতারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

তাদের প্রতারণামূলক কর্মসূচির নবতম সংস্করণ “ব্যাটল অব মাইন্ড”। মূলত বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে তামাকজাত দ্রব্যের প্রত্যক্ষ প্রচার-প্রচারণা, বিজ্ঞাপন ও প্রণোদনা নিষিদ্ধ হওয়ায় তামাক কোম্পানিগুলো চাকুরী প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আইন লঙ্ঘণ প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি’ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে “ব্যাটল অব মাইন্ড” নামক কর্মসূচি পরিচালনা করছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির আড়ালে তামাক কোম্পানির ইমেজ গড়ে তোলার অপচেষ্টা। হাজার হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে বিএটিবিতে স্থায়ীভাবে মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন কাজ করার সুযোগ পায়। দেশে কর্মসংস্থানের অভাবকে পুঁজি করে বিএটিবি কতৃপক্ষ “ব্যাটল অব মাইন্ড” নামক কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিল করতে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে অনুষ্ঠান আয়োজন, স্পন্সরশীপ প্রদানের আড়ালে মূলত তামাকজাত দ্রব্যের প্রচারণাই তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য। আর এ কাজে তরুণদের অন্তর্ভূক্ত করা তাদের ব্যবসা সম্প্রসারনের অন্যতম বড় কৌশল ও সফলতা। অন্যদিকে, জমকালো অনুষ্ঠানের আড়ালে তামাক কোম্পানি দেশের তরুণ সমাজকে লক্ষ্যহীন গাঢ় অন্ধকারের পথে ধাবিত করছে, সে খবর খোদ অভিভাবক ও সমাজের সচেতন মহল রাখেন না।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে এ পণ্যের বাজার প্রসার বা মানুষকে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারে আকৃষ্ট করতে কোন ধরনের প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতার নামে তামাক কোম্পানির প্রচার নিষিদ্ধ। এরপরও ২০১৫ সালে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশে শুধুমাত্র সিগারেটের ব্রান্ড প্রমোশনে ব্যয় করেছে ১৯৩ কোটি টাকার বেশি! অথচ ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) এর ৫ (গ) ধারায় তামাক কোম্পানির নাম, সাইন, ট্রেডমার্ক, প্রতীক ব্যবহার করে এ ধরনের কোন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার বহন ও পুরস্কার প্রদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি আইনের এই ধারা লংঘন করলে অনধিক এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা অনুর্ধ্ব তিন মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান বলবৎ আছে।

তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারে উদ্ধুদ্ধ করতে অভিনব প্রচার, প্রচারণার অংশ হিসাবে কোম্পানির প্রতিনিধিরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় সিগারেটের প্রচারণার অংশ হিসেবে কুইজ, বেলুন ফুটানো, বিনামূল্যে টি-শাট, লাইটার, ব্যাগ, মানিব্যাগ, ব্যাচলাইট, ফ্রি সিগারেট বিতরণের মত আইন বহির্ভূত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তামাক কোম্পানিগুলো কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত তরুণ-তরুণীদের পার্টটাইম কাজে নিয়োজিত করার মাধ্যমে এধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। লক্ষ করা যায়, তামাক কোম্পানিগুলো স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং জনবহুল শপিংমলের আশেপাশে এ ধরনের কার্যক্রম বেশি বেশি পরিচালনা করছে যাতে তরুণদেরকে ধূমপানে সহজেই আকৃষ্ট করা যায়। এসকল বিক্রয়কর্মীদের মধ্যে অধিকাংশই বয়সে তরুণ এবং বিভিন্ন কলেজ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রী। মূলত, মিথ্যে চাকুরীর প্রলোভনে তরুণ-তরুণীদেরকে তাদের ব্র্যান্ড প্রমোশনের কাজে ব্যবহার করছে কোম্পানীগুলো।

সুনাগরিক হিসাবে গড়ে উঠতে ও স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য তরুণদের নেশা থেকে দুরে থাকা ও ইতিবাচক কাজে সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু,বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে তরুণদেরকে সিগারেট ফেরি করে বিক্রি করতে দেখা হতাশাজনক! দেশের কর্মসংস্থান সংকটের বিষয়ে সকলে অবগত। কিন্তু, নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে মৃত্যুশলাকা হাতে নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কাজ থেকে সবারই বিরত থাকা উচিত। এতে ধূর্ত তামাক কোম্পানির মুনাফা অর্জন হবে, তামাকের কারণে মানুষ অকালে প্রাণ হারাবে।

উল্লেখ্য, তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের দাবির মুখে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় “ব্যাটল অব মাইন্ড” কর্মসূচি বন্ধ করতে বাধ্য হয়। সে বছরেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র সাঈদ খোকন ‘ব্যাটল অব মাইন্ড ২০১৭’ প্রতিযোগিতার গ্রান্ড ফিনালে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করার কথা থাকলেও তিনি তা বর্জন করেন। সম্প্রতি, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ ব্যাটল অব মাইন্ড কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়। এসব আমাদের আশান্বিত করে। দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায় থেকে সকলকে তামাক কোম্পানির অনৈতিক কার্যক্রম বর্জন বর্জন করতে হবে।

তামাক কোম্পানি রাষ্ট্রীয় আইনের উর্ধ্বে নয়। বরং জনস্বাস্থ্যকে প্রধান্য দিয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। এজন্য তামাক কোম্পানির ‘ব্যাটল অব মাইন্ড’সহ সব ধরনের অপতৎপরতা বন্ধ করা জরুরী। আশা করি, সরকারের সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ অবিলম্বে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

লেখক: মো. আবু রায়হান, উন্নয়ন কর্মী