৬২ শতাংশ তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কেরই উভয় পাশে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ করা হচ্ছে না, গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ

তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের হার গত বছরের চেয়ে ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ শতাংশে। তবে তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে এটা যথেষ্ঠ নয় বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও তামাক নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা। কারণ এই সতর্কবাণী ৬২ শতাংশ মোড়কের উভয়পাশেই মুদ্রণ করা হয় না। সচিত্র সতর্কবাণীর হার ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ জায়গা জুড়ে মুদ্রণের দাবি জানান তারা। ৩০ জানুয়ারি ২০২২ (রবিবার) সকাল ১১.০০ টায় ঢাকা হোটেল গোল্ডেন ইন-এ টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি), ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভির্সিটি ও বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট (বাটা)-এর আয়োজনে ‘তামাকজাত দ্রব্যের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বাস্তবায়ন- বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক এক গবেষণার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে তারা এসব দাবি জানান ।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী হেলাল আহমেদের সভাপতিত্বে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হার্ট ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক ড. সোহেল রেজা চৌধুরী, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এস এম আব্দুল্লাহ, আর্ন্তজাতিক সংস্থা দ্য ইউনিয়নের কারিগরি পরামর্শক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম, ভাইটাল স্ট্রাটেজিস এর কান্ট্রি ম্যানেজার নাসির উদ্দিন শেখ। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপচার্য অধ্যাপক ড. গণেশ চন্দ্র সাহা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি)-এর সদস্য সচিব ও প্রজেক্ট ডিরেক্টর এবং ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক মো. বজলুর রহমান। গবেষণার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি)-এর সহকারী গবেষক ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা জামান লিজা। এছাড়া অনুষ্ঠানে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠনের তামাক নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা।

মূল প্রবন্ধে ফারহানা জামান লিজা বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণের নানা পদ্ধতির মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান অন্যতম। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধনী ২০১৩) এর ধারা ১০ অনুযায়ী সকল তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের উভয়পাশের মূল প্রদর্শনী তলের উপরিভাগের ৫০ শতাংশ এলাকা জুড়ে তামাকের স্বাস্থ্য ক্ষতি সম্পকিৃত সচিত্র সতকর্বার্তা প্রদান করতে হবে। টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরতে গত সেপ্টেম্বর ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত দেশের ৮টি বিভাগের ২৪ টি জেলার ১৫৫২টি তামাকজাত দ্রব্যের মোড়ক থেকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে।

টিসিআরসির গবেষণায় বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে, তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ৮২% তামাকপণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী পাওয়া গেছে; ৬২% মোড়কের উভয়পাশে এই সতর্কবাণী মুদ্রণ করা হয়নি; ৫৮% মোড়কেই পঞ্চাশ শতাংশ এলাকা জুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ করা হয়েছে; ২৮% মোড়কের উপরের দিকে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রিত হয়েছে; ৪% মোড়কে ছবির সাথে লিখিত বার্তা প্রদান করেনি; ৪% মোড়কে আইনে প্রদত্ত ছবি না দিয়ে পাশ^বর্তী দেশের ছবি মুদ্রণ করতে দেখা গেছে; ১৮% মোড়কের লিখিত সতর্কবাণী কালো জমিনে সাদা অক্ষরে মুদ্রিত হয়নি; ৭১% বিড়ির মোড়কের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ব্যান্ডরোল দিয়ে ঢেকে থাকতে দেখা গেছে; এবং ৫১% মোড়কেই “শুধুমাত্র বাংলাদেশে বিক্রয়ের জন্য অনুমোদিত” মর্মে কোন বাণী প্রদান করা হয়নি; কোনো সিগারেটের কার্টনেই সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী পাওয়া যায়নি।

অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, নীতি পরিবর্তনের জন্য অ্যাডভোকেসি আরো জোরদার করতে হবে। যদিও গবেষণায় ফাইন্ডিং এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে তারপরও নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় ফলোআপ জরুরি। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিসহ কিছু নীতি প্রণয়নের কাজ চলছে। যা আরো জোরদার করতে হবে।

সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, গবেষণা করে অ্যাডভোকেসিতে ব্যবহার করতে হবে। একইসঙ্গে অ্যাকাডেমিক জার্নালে প্রকাশ করতে হবে। যথাযথভাবে ডকুমেন্টেশন করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় কোম্পানির অনেক বায়াস রিসার্চ ফলাও করে প্রকাশ হয় কিন্তু আমাদের মানসম্মত রিসার্চ গুলোও সেভাবে প্রচার হয় না। ফলে আমাদেরকে প্রচারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। একইসঙ্গে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গবেষণা পরিচালিত এলাকার ডিসি ও সিভিল সার্জনসহ সংশ্লিষ্টদেরকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের জন্য অনুরোধ জানাতে হবে।

এস এম আব্দুল্লাহ বলেন, তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেজিংয়ের আইন ও নীতি বাস্তবায়ন করা জরুরি। যে তামাক কোম্পানিগুলো এগুলো মানছে না তাদের উৎপাদিত পণ্য অবৈধ বলতে পারি। পাশাপাশি কর ফাঁকি রোধে তামাক পণ্যের স্টান্ডার্ড প্যাকেজিংয়ের দিকে যেতে হবে উন্নত দেশের সাথে মিল রেখে। বাংলাদেশ এফসিটিসি স্বাক্ষরকারী দেশ। সুতরাং এর প্রতিপালনের বিষয়টি লক্ষ রাখতে হবে। এনটিসিসি, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

উপচার্য অধ্যাপক ড. গণেশ চন্দ্র সাহা বলেন, তামাক বিরোধী সংগঠনগুলোর কাজে সমন্বয় প্রয়োজন। কারণ আমাদের প্রতিপক্ষ তামাক কোম্পানি অনেক শক্তিশালী। ফলে তাদের বিপক্ষে কাজ করতে তামাক বিরোধী ফোরামগুলোকে আরো শক্তিশালী ভূমিকা পালন করা জরুরি। তামাক বিরোধী আন্দোলনে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। একইসঙ্গে গবেষণা ফলাফলগুলো উন্মুক্ত করতে হবে।

অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যে হেলাল আহমেদ বলেন, টিসিআরসি বাংলাদেশে প্রথম কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক গবেষণা সেল। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও এটা অনুসরণ করতে পারে। টিসিআরসির প্রস্তাবিত স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং মডেলটি ইতিমধ্যেই জন হপকিংস বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করেছে। বিশে^র অনেক দেশ এ মডেল বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমাদের দেশ থেকে এই ধারণাটি উন্নত বিশ্ব গ্রহণ করা সত্ত্বেও আমরা এখনও এটি বাস্তবায়নের দিকে যেতে পারিনি। আমাদেরকে  দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যে স্টান্ডার্ড প্যাকেজিংয়ের মডেল বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।